বোকা হরিশঙ্কর একটু ভয়ে-ভয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, “পায়েসপুরের কি আলাদা নিশেন আছে হারুখুড়ো?”
হারাধন বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, “তা থাকবে না কেন? নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু সেই ঐতিহ্য আমরা হারিয়ে ফেলেছি। ওরে, নিশেন তৈরি তো আর শক্ত নয়। তিন টুকরো রঙিন কাপড় জুড়লেই একটা নিশেন খাড়া করা যায়। শক্ত কাজ হল সেটাকে বিশ্বের বুকে উড়িয়ে আসা। আর বটেশ্বর সেটা ঠিক পারবে। যে হারে মাসলগুলো দিন কে-দিন কিলবিলিয়ে উঠছে, তাতে একদিন নোবেল প্রাইজও এনে ফেলবে, দেখিস!”
গোবিন্দ অবাক হয়ে বলল, “কিন্তু খেলাধুলো বা স্বাস্থ্যের জন্য তো নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয় না!”
হারাধন গলা তুলে বললেন, “কে বলল দেওয়া হয় না? এই যে সেদিন নর্মদাদিদির হাতের রান্না নিমসুক্তো আর চাপড় ঘণ্ট খেয়ে তার নাতজামাই বলে গেলেন, আপনাকে নোবেল প্রাইজ দেওয়া উচিত! সে কী কঁকা কথা? সেই নাতজামাই কোন ইউনিভার্সিটির যেন প্রোফেসর। তিনি কি না জেনে বলেছেন? তা রান্নাবান্নায় যদি নোবেল থাকে, তা হলে স্বাস্থ্যের খাতেও আছে।”
গোবিন্দ একটু মিইয়ে গিয়ে বলল, “সেরকমই যেন শুনেছিলাম।”
তা বটেশ্বরের এত বড় ভক্ত হারাধনবাবু দানুর বীরত্বের কথা শুনে দানুর দিকে একেবারে ঢলে পড়েছেন। ঘটনার পরদিনই গিয়ে দানুকে বলে এসেছেন, “বুঝলি দানু, উনিশশো বত্রিশ সালে এ গাঁয়ের রমেশ কুমোর হাত দিয়ে বাঘ মেরেছিল, আর তারপর এই তুই। পায়েসপুরের ইজ্জত রেখেছিস, মুখোজ্জ্বল করেছিস। এবার অলিম্পিকের জন্য তৈরি হ’। পায়েসপুর তোর মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে বাবা!”
বীরেশ বলল, “তা কী করে হবে? ও তো পায়েসপুরের ছেলে নয়? ওর বাড়ি প্রতাপগড়ে।”
হারাধন খিঁচিয়ে উঠে বললেন, “বললেই হবে প্রতাপগড়ে? সেখান থেকে তো ওকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পায়েসপুরের সম্মান রাখতে দরকার হলে আমি ওকে পুষ্যি নেব।”
সময়টা খারাপই যাচ্ছে বটেশ্বরের। এই কদিন আগেও রাস্তায় বেরোলে আশপাশের লোকেরা কথা থামিয়ে হাঁ করে চেয়ে দেখত। হাটেবাজারে লোকজন বিকিকিনি থামিয়ে এ-ওকে ডেকে দেখাত, ‘ওই দ্যাখ, বটবৃক্ষ যাচ্ছে!’ পানুবাবুর সঙ্গে পথে দেখা হলেই বিগলিত হাসির সঙ্গে হেঁ-হেঁ করতে-করতে আর হাত কচলাতে কচলাতে পানুবাবু বলতেন, “হে-হেঁ, কী স্বাস্থ্য! কী স্বাস্থ্য! দেখলেও চোখ সার্থক। হে-হেঁ, কী পেশিই বানিয়েছেন বটুবাবু, যেন জলের মধ্যে মাগুরমাছ খেলে বেড়াচ্ছে। হেঁ-হেঁ, এই যে এত মাসলের বোঝা নিয়ে হেঁটেচলে বেড়ান, একটু ভারী-ভারী লাগে না?”
তা বটেশ্বরের সেই স্বণযুগ আর নেই। বটেশ্বর এখনও রাস্তায় বেরোয় বটে, কিন্তু লোকজন তাকে যেন তেমন লক্ষই করে না। বরং অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। হাটেবাজারে বটেশ্বরকে দেখা তো দূরের কথা, সেদিন একটু কাঁচালঙ্কা ফাউ চেয়েছিল বলে লঙ্কাওয়ালা এমন খ্যাক করে উঠল যে, বটেশ্বর ভারী অপমানিত বোধ করেছিল। বটেশ্বর বুঝতে পারছে যে, পায়েসপুরে তার একচ্ছত্র আধিপত্য আর নেই। আর এসবের মূলে ওই ল্যাকপ্যাকে, হাড়গিলে চেহারার ঢ্যাঙা দানু। এই যে তার একনিষ্ঠ ভক্ত পানুবাবু, দেখা হলে আজকাল আর হাসি নেই, বিস্ময় নেই, হে-হেঁ পর্যন্ত নেই। মুরুব্বির মতো একটু ঘাড় হেলিয়ে গম্ভীর গলায় শুধু বলেন, “চালিয়ে যান বটুবাবু।”
দুঃখী বটেশ্বর তাই বিকেলের ব্যায়াম-ট্যায়াম সেরে এক সন্ধেবেলা মাঠের ধারে একা-একা বসে দুঃখের কথাই ভাবছিল। দানু ফুটবল খেলা জানে না, অথচ গোল দেয়। তার চেহারা ল্যাকপ্যাকে হলেও গায়ের জোরে কেউ তার সঙ্গে পারে না। সে দু’দিনে তিরিশ-চল্লিশটা গাছের সব ফল পেড়ে ফেলতে পারে। একদিনে বিরাট পুকুরটার সব কচুরিপানা তুলে ফেলে। এসব হচ্ছেটা কী? ভগবানের এ কী অবিচার রে বাবা! সে এত কষ্ট করে বুকডন-বৈঠকি মেরে, বারবেল-ডাম্বেল-মুগুর ভেঁজে মাল ফোলাল, আর বীরের সম্মান পেয়ে গেল হাড়গিলে ঢ্যাঙা দানু! তা হলে ব্যায়ামট্যায়াম করে লাভ হল কী?
আকাশে মেঘটেঘ ছিল না, দুযোর্গের কোনও আভাসও নেই। কিন্তু হঠাৎ একটা বিকট বজ্রপাতের শব্দে আঁতকে উঠে বটেশ্বরের ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। মাথায় হাত দিয়ে চোখ বুজে ফেলেছিল সে। চোখ চেয়ে দেখল, সামনে এক বিভীষিকা দাঁড়িয়ে আছে। বিশাল লম্বা-চওড়া চেহারার রক্তাম্বর পরা এক সাধু। হাতে পেল্লায় ত্রিশূল, মাথায় জটাজুট, ঘন দাড়ি-গোঁফ, গলায় রুদ্রাক্ষ, আর চোখ দু’খানা অন্ধকারেও জ্বলছে। তার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে দেখে বটেশ্বর একটু কুঁকড়ে গেল। ফের বজ্রকণ্ঠে সাধু বলে উঠল, “তুই! তুই এখানে কী করছিস?”
ভয়ে পেটের ভিতরটা গুড়গুড় করে উঠল বটে, কিন্তু শত হলেও তো বটেশ্বর পায়েসপুরের পয়লা নম্বরের পালোয়ান। তাই সে কাঁধটা একটু ঝাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের সঙ্গেই বলল, “দেখতেই তো পাচ্ছেন মশাই, বসে হাওয়া খাচ্ছি।”
সাধু অতি বিকট গলায় বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, “হাওয়া খাচ্ছিস? তোর কি হাওয়া খাওয়ার কথা?”
“কেন মশাই, আমি হাওয়া খেলে আপনার অসুবিধে কী? নিজের কাজে যান তো মশাই, মেলা ঝামেলা করবেন না।”
তার তড়পানি দেখে সাধু যেন বিস্ময়ে মূক হয়ে গেল। তারপর হঠাৎ “তবে রে বেআদব,” বলে তার নড়া ধরে এক হ্যাচকা টানে দাঁড় করিয়ে সপাটে গালে একটা চড় কষিয়ে বলল, “চ্যাটাং-চ্যাটাং কথা কইছিস যে বড়! কে তোকে ছেড়ে দিয়েছে বল, কোন সাহসে তুই মাঠে-ময়দানে বসে গায়ে হাওয়া লাগাচ্ছিস?”