কিন্তু খেলা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই টাইগাররা দুর্দান্ত খেলে দু’টো গোল দিয়ে দিল। আরও দু’টো দিতে পারত, অল্পের জন্য হল না। বিপদ বুঝে হাফটাইমের পর দানুকে নামানো হল। দানু শুধু একবার প্রাণারামকে জিজ্ঞেস করল, “ক’টা গোল করতে হবে বলো তো?”
প্রাণারাম হেসে বলল, “য’টা চাইব ত’টা গোল দিতে পারবি? যা, তা হলে পাঁচ গোল দিস।”
দানু তার স্বভাবসিদ্ধ অষ্টাবক্র মুনির মতো লম্বা শরীর এবং লম্বা-লম্বা পায়ে এমন এঁকেবেঁকে সারা মাঠ জুড়ে দাপাতে লাগল যে, লোকে হাঁ। এবং নামবার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই একখানা ধাঁই শটে গোল। কিন্তু গোল করার পরও টাইগার্সদের ব্যাক বিপ্লব বুটসুদ্ধ পায়ে দানুর বুকে একটা লাথি জমিয়ে দিতে ছাড়েনি। দানু অবশ্য একটু গড়াগড়ি দিয়ে ফের খাড়া হয়ে তার কাঁকড়ার ভঙ্গিতে খেলা শুরু করে দিল। পাঁচ মিনিটের মাথায় হাফলাইনের কাছ থেকে একখানা রামধনু শট করে বসল দানু। আর সেটা উপরে উঠে গোগাত্তা খেয়ে গোলকিপারের মাথা টপকে গোলে ঢুকল। যথারীতি ফের খেলা শুরু হতেই দানুকে লক্ষ করে চোরাগোপ্তা মার, লাথি, পায়ের ডিমে মারা, মাথায় কনুই দিয়ে ঠুকে দেওয়া, এসব চলতে লাগল বটে, কিন্তু বিশেষ সুবিধে হল না। বরং দানুকে চার্জ করতে গিয়ে ওদের গোটা দুই প্লেয়ারের ভালরকম চোট হয়ে মাঠ ছাড়তে হল। ফ্রি-কিক থেকে আরও একটা গোল দিল দানু। খেলার শেষ দিকটায় হ্যাঁদানো টাইগার্সদের দম ফুরিয়ে আসছিল। অনায়াসে আরও দু’টো গোল দিয়ে দিল দানু। দলের সবাই এসে জড়িয়ে ধরল দানুকে। প্রাণারাম পিঠ চাপড়ে বলল, “ওঃ, আমার মুখ রেখেছিস!”
কিন্তু রক্ষার আরও বাকি ছিল। নিজেদের ঘরের মাঠে পাঁচ পাঁচটা গোল হজম করা হবিবপুরের মারকুট্টা লোকদের পক্ষে খুব শক্ত ব্যাপার। খেলার শেষে আপ্যায়নের পর তারা যখন একটা খোলা ট্রাকে চেপে ফিরছে, তখন রথতলার কাছে দেখা গেল, পথ জুড়ে একটা গাছের গুঁড়ি পড়ে আছে। ট্রাকটা থামতেই দু’পাশ থেকে লাঠিসোটা নিয়ে জনাকুড়ি-পঁচিশ ছেলে তেড়ে এসে দমাদম লাঠি আর হকিস্টিক নিয়ে বেধড়ক মারতে শুরু করল তাদের। প্রথমটায় হকচকিয়ে গিয়ে সবাই পালানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু গুন্ডারা এমন ভাবে ঘিরে ধরেছে যে, পালানো অসম্ভব। মারের চোটে তাদের প্রাণসংশয়। ঠিক এই সময় লগবগে, রোগা, আপাতনিরীহ দানু কিন্তু ফস করে একজনের হাত থেকে লাঠি কেড়ে নিয়ে একাই এমন পালটা মার দিতে শুরু করল, যা অবিশ্বাস্য। লাঠি সেও কম খেল না। কিন্তু সেসব গ্রাহ্য না করে সে এমন লাঠিবাজি করে যাচ্ছিল যে, প্রতিপক্ষ রণেভঙ্গ দিয়ে পালাতে পথ পায় না।
গাঁয়ে ফিরে দানু বীরের সম্মান পেল বটে, কিন্তু তাতে তার বিশেষ হেলদোল নেই। যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব দেখিয়ে সে সরযূদেবীর বাড়িতে ফিরে নিজের কাজকর্ম সারতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
প্রাণারাম এসে বলল, “হ্যাঁ রে দানু, একটা সত্যি কথা বলবি? মাঝে-মাঝে কি তোর উপর কোনও দৈবশক্তি ভর করে? পাঁচ পাঁচটা গোল করলি, সে না হয় হল। কিন্তু কুড়ি-পঁচিশটা ছেলের সঙ্গে লড়াই করলি কী করে?”
দানু নির্বিকার মুখে বলল, “না লড়লে যে মার খেতে হত?”
প্রাণারাম মাথা নেড়ে বলল, “না রে, তুই সোজা লোক নোস। তোর ভিতরে কিছু একটা আছে।”
পায়েসপুরের বীর বলে এতকাল খ্যাতি ও খাতির ছিল বটেশ্বরের। তা বটেশ্বরের চেহারা পেল্লায়। সে তেমন লম্বা নয় বটে, কিন্তু চওড়ায় পুষিয়ে নিয়েছে। সারা শরীরে পেশির বন্যা। বটেশ্বর নড়লেই শরীরের গোল্লা-গোল্লা পেশি পান্তুয়ার মতো ভেসে ওঠে। বীরত্বের কাজ সে এখনও তেমন কিছু করে উঠতে পারেনি বটে, কিন্তু দরকার পড়লে যে করবে, সেই ভরসা গায়ের মানুষদের আছে। সে মোটা-মোটা লোহার রড বাঁকাতে পারে, এক প্যাকেট তাস দু’ হাতে টেনে ছিঁড়ে ফেলতে পারে, তিন-চার মন ওজন তুলতে পারে। দানুর কীর্তি-কাহিনি শুনে সে নাক সিটকে বলল, “ওই হাড়গিলে ছেলেটা। দুর-দুর, ও আবার কী মারপিট করবে? আমি জোরে ফুঁ দিলেই তো উড়ে যাবে!”
হারাধনবাবুকে এক হিসেবে দেশপ্রেমিক বলা যায়। তিনি অবশ্য ভারতবর্ষের খবরাখবর তেমন জানেন না, প্রদেশ বা জেলা বা এমনকী মহকুমা নিয়েও তার তেমন মাথাব্যথা নেই। তার মতে পায়েসপুরই হচ্ছে পৃথিবীর সেরা জায়গা। কাজেই পায়েসপুরের গৌরবেই তিনি সর্বদা গৌরবান্বিত। সর্বদাই তিনি সকলকে পায়েসপুরের ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। এই পায়েসপুরেই নাকি একদা রাজা মানসিংহের সৈন্যরা আমবাগানের ছায়ায় জিরিয়েছিল, আর তাদের ঘোড়াগুলো জল খেয়েছিল ময়নামতীর দিঘিতে। গোরাদের আমলে দু’জন সাহেবও নাকি পায়েসপুরের বিখ্যাত ডাকাত বিষ্ণু বাগদিকে গ্রেফতার করতে আসে। তারা কবুল করে গিয়েছিল যে, এরকম ডাকাবুকো ডাকাত তারা কস্মিনকালেও দেখেনি। প্রতাপগড়ের গৌরবের আমলে রাজা বীরবিক্রম নাকি এই পায়েসপুরের চাটাইয়ের খুব সুখ্যাতি করেছিলেন। এক সময় পায়েসপুর নাকি মিষ্টি কুমড়োর চাষে ভারতবর্ষের এক নম্বর ছিল এবং মেটে কলসি তৈরিতে এই পায়েসপুরের মৃৎশিল্পীদের সঙ্গে কেউ এঁটে উঠত না। ইতিহাসবিত হয়ে আছে এই গাঁয়ের অতি বিচক্ষণ চোর সর্বেশ্বর। আর পণ্ডিত বিনোদবিহারীর নামও সবাই জানে। যিনি বাংলা ব্যাকরণ ‘দীপশিখা’ লিখে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। এ গাঁয়ের এখনকার গৌরবও বড় কম নয়। বনমালীবাবু এত ভাল ইংরেজি জানতেন যে, গোরা ম্যাজিস্ট্রেট নাকি বলেছিলেন, ‘বনমালী কাছে থাকলে কারও ডিকশনারি খোলার দরকার হয় না। বনমালীবাবু আটানব্বই বছর বয়সে এখনও বেঁচে আছেন। এ গাঁয়েরই রায়পাড়ার বাসব নন্দী কেশবপুরের জমিদারের ছোট মেয়ের বিয়েতে আশিটা রসগোল্লা খেয়ে যে খবরের কাগজে নাম তুলেছিল, সেটাও ভুলে গেলে চলবে না। খবরের কাগজের কাটিং হারাধন যত্ন করে ফাঁইলে রেখে দিয়েছেন। হারাধন বিশ্বাস করেন বটেশ্বর একদিন ‘ভারতী’ এবং তারপর ‘বিশ্বশ্রী’ হয়ে গ্রামের মুখ উজ্জ্বল করবে। তাই তিনি প্রায়ই বটেশ্বরকে তাড়না করেন, “ওহে, উঠে পড়ে লাগো তো! বুক ফুলিয়ে গিয়ে বিশ্বশ্রী হয়ে ইউ এন ও-তে পায়েসপুরের নিশান উড়িয়ে দিয়ে এসো!”