তা সেই থেকে দানু সরযূদেবীর বাড়িতেই আছে। দেখা গেল, সে খুবই কাজের ছেলে। পিসির চল্লিশ-পঞ্চাশটা নারকেল গাছের পুরুষ্টু নারকোল সব দু’-চারদিনের মধ্যে পেড়ে ফেলল সে। তারপর বিরাট পুকুরের সব কচুরিপানা তুলে ফেলল। বাগান পরিষ্কার করে মাটি কুপিয়ে নতুন গাছের চারা লাগাল। হাটবাজার করা, কাঠ কাটা, কুয়োর জল তোলা, সব কাজেই সে বেশ পোক্ত! কয়েকদিনের মধ্যেই সরযূদেবী তাকে ভারী ভালবেসে ফেললেন। এখন তার দানু ছাড়া এক মুহূর্ত চলে না। একদিন প্রাণারামকে বলেই ফেললেন, “বড্ড মায়া পড়ে গিয়েছে রে! ছেলেটিকে পুষ্যি নেব কিনা ভাবছি।”
সেদিন শীতলা ক্লাবের সঙ্গে বাবুপাড়ার ওল্ড ফাঁইটার্স ক্লাবের ফ্রেন্ডলি ম্যাচ। কিন্তু শীতলা ক্লাবের দু’-দু’জন বাঘা প্লেয়ারের জলবসন্ত হয়েছে। চিন্তিত প্রাণারাম এসে দানুকে বলল, “হ্যাঁ রে, তুই ফুটবল খেলতে পারিস?”
দানু ঘাড় কাত করে একগাল হেসে বলল, “খুব পারি! একবার চান্স দিয়েই দ্যাখো না!”
উপায় ছিল না বলে সেদিন শীতলা ক্লাবের দলে দানুকে নামানো হল। কিন্তু দানুর খেলা দেখে সবাই হেসেই অস্থির। লম্বা পায়ে তার লগবগ করে দৌড় আর দড়াম-দড়াম করে আছাড় খাওয়া দেখে একবার তাকে বসিয়ে দেওয়ার কথাও ভেবেছিল প্রাণারাম। মাঠের চারদিকে জড়ো হওয়া দর্শকদের মধ্যে হাসির লহর বইছে। তার মধ্যে অবশ্য গাঁয়ের সবচেয়ে বোকা লোক হরিবন্ধু নফরও ছিলেন। তিনিই শুধু বলেছিলেন, “এই ছেলেটির সঙ্গে মারাদোনার খুব মিল।”
এ কথা শুনে পাশে বসা সুধীরবাবু চটে উঠে বললেন, “এর সঙ্গে মারাদোনার মিল আর বাঘের সঙ্গে খরগোশের মিল একই কথা। মারাদোনা বেঁটে, হোঁতকা, আর এ হল ঢ্যাঙা আর রোগা। তা হলে মিলটা পেলে কোথায়?”
হরিবন্ধু আমতা-আমতা করে বললেন, “তা বটে! তবে একটা কেমন মিলও যেন আছে। পেটে আসছে, মুখে আসছে না।”
যাই হোক, হাফটাইমের মধ্যেই ওল্ড ফাঁইটার্স শীতলা ক্লাবকে তিন গোল দিয়ে বসল।
হাফটাইমে দানুকে বসিয়ে দেওয়ার কথা উঠতেই কালীপদবাবু বললেন, “তোমরা হয়তো লক্ষ করোনি, দানু খেলা না জানলেও প্রচুর দৌড়তে পারে, আর ল্যাং খেয়েও দমে যায় না। এ দু’টো গুণের জন্য ওকে খেলানোই উচিত হবে। তা ছাড়া আমাদের প্লেয়ারও শর্ট।”
হাফটাইমের পর খেলা শুরু হতেই কিন্তু দেখা গেল, মাঝমাঠ থেকে বল ধরে দানু লম্বা-লম্বা পায়ে দৌড়চ্ছে। বারদুয়েক ল্যাং খেয়ে পড়ে গেল বটে, কিন্তু ফের উঠে দৌড়ে গিয়ে বল ধরে ফেলল। তারপর এর-ওর-তার পায়ের ফাঁকফোকর দিয়ে কী করে যেন ফাঁইটার্সদের গোলে বলটা ঢুকিয়ে দিল। মাঠের চারদিকে হইহই উঠল। এর পরের গোলটা দানুই দিল প্রায় সেই একই ভঙ্গিতে। তবে এবার খুব এঁকেবেঁকে দৌড়ে কয়েকজনকে পাশ কাটিয়ে শেষে হাঁটুর ওঁতোয় গোল। এমন আনাড়ির কাছে গোল খেয়ে ওল্ড ফাঁইটার্সরা খেপে উঠে দানুকে প্রায় ঘিরে ফেলতে লাগল। সে বল ধরলেই চার-পাঁচজন এসে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। ল্যাং মারা, জামা বা হাত ধরে টানা, কনুই দিয়ে পাঁজরে মারা, কিছুই বাকি রাখল না তারা। কিন্তু দানুকে তবু রোখা গেল না। দশ মিনিটের মাথায় সে অনেক দূর থেকে একটা এমন আনতাবড়ি ভলি মেরে বসল যে, সেটা কামানের গোলার মতো গিয়ে ফাঁইটার্সের গোলে সেঁধিয়ে গেল। শোধবোধ। খেলা শেষ হওয়ার পাঁচ মিনিট আগে যখন গোল করার জন্য গোটা ফাঁইটার্স দল শীতলা ক্লাবের পেনাল্টি বক্সে উঠে এসেছে, তখন প্রাণারাম হঠাৎ পায়ে বল পেয়ে ফাঁকা জমিতে প্রু বাড়িয়ে দিল, যদি কেউ সেটা ধরে গোল করতে পারে। পারল দানুই। কারণ, সে এত জোরে ছোটে যে, কেউই তার সঙ্গে গতিতে তাল রাখতে পারে না। একা বল ধরে ফাঁকা মাঠে লম্বা পায়ে এক লহমায় গোলের মুখে পৌঁছে গেল দানু। ওদের গোলকিপার ড্রাইভ দিয়ে পানুর পা জড়িয়ে ধরে ফেলে দিল বটে, কিন্তু বলটা ছিটকে গোলে ঢুকেও গেল।
সেই থেকে দানু শীতলা ক্লাবের নিয়মিত খেলোয়াড়। যদিও সে পাস দিতে জানে না, ড্রিবল করতে গেলেই পড়ে যায়, নিজের জায়গায় পজিশন নিতে ভুলে যায়, তবু রোজই নানা কিম্ভুত উপায়ে একটা-দুটো গোল ঠিকই দিয়ে দেয়।
একদিন প্রাণারাম দানুকে ডেকে বলল, “দ্যাখ দানু, তোর মধ্যে কিন্তু প্রতিভা আছে। কিন্তু অত আনাড়ির মতো খেলিস কেন? কায়দাকানুন একটু শিখলে হয় না?”
দানু উদাস হয়ে বলল, “কাজ কী শিখে? তুমি তো গোল চাও, সেটা হলেই তো হল!”
“তা বটে! কিন্তু অপোনেন্ট প্লেয়াররা যে তোকে এত ল্যাং মারে, তোর ব্যথা লাগে না? যেদিন মনোজ তোর হাঁটুতে বুট চালিয়েছিল, তাতে মালাইচাকি চৌচির হয়ে যাওয়ার কথা!”
দানু একগাল হেসে বলল, “লাগবে না? খুব ব্যথা লাগে। তবে কী জানো, কষ্ট করে বড় হয়েছি তো, তাই ব্যথা সহ্য করতে পারি। আমার হাড়গোড় খুব শক্ত।”
“তাই দেখছি, ঠিক আছে, তুই তোর মতোই খেলিস।”
আন্তঃজেলা লিগের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে হবিবপুরের ইলেভেন টাইগার্সের সঙ্গে তাদের গায়ে খেলতে গিয়েছিল শীতলা ক্লাব। গিয়ে হাজির হতেই হবিবপুরের লোকেরা এসে একজনেরই খোঁজখবর করতে লাগল, “দানু কে? দানু কোথায়? কোন ছেলেটি দানু বলল তো!”
বোঝা যাচ্ছিল, আজ ম্যাচে দানুর কপালে দুঃখ আছে। কালীপদ ঘোষ আর প্রাণারাম মিলে ঠিক করল, আজ দানুকে মাঠে না নামিয়ে রিজার্ভে রাখা হবে। কেন না, আজ ওদের লক্ষ্যই হবে দানুকে মেরে অকেজো করে দেওয়া।