গজপতি সবিস্ময়ে বলে উঠলেন, “প্রায় দেড়শো বছর বয়সে?”
“হ্যাঁ। সে কী চেহারা রে বাবা, যেন বাঘ! চোখ দুখানা দিয়ে যেন আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে। দুপুরবেলা এসে বজ্রগম্ভীর স্বরে আমার নাম ধরে ডাকল। সেই সাধু যে সত্যিই তার জিনিস ফেরত নিতে পঁচাত্তর বছর পর হাজির হবে, একথা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। ভেবেছিলাম, গুল মেরে গিয়েছে। কিন্তু সে আমার বাবার নাম করে আদ্যোপান্ত ঘটনাটা বলে যখন প্রদীপটা ফেরত চাইল, তখন অবিশ্বাস করি কী করে? আমি ছাড়া সেই ঘটনার তো আর সাক্ষী নেই!”
খগেন বললেন, “তা প্রদীপটা দিয়ে দিলেন নাকি তাকে?” নগেন প্রবল একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “পারলাম কই? প্রদীপ বের করতে গিয়ে দেখি, ঠাকুরের সিংহাসনের তলায় তালা দেওয়া যে ভারী কাঠের বাক্সে তা ছিল, সেটা ফাঁকা। প্রদীপের চিহ্নমাত্র নেই। প্রদীপ পাওয়া যাচ্ছে না শুনে সাধুর কী রাগ। শরীরটা যেন দু’নো হয়ে উঠল, চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। বলল, ‘সাত দিনের মধ্যে যদি প্রদীপ না দিস, তা হলে ঝাড়েবংশে মারা যাবি।’ এই বলে সাধু চলে গেল। সেই থেকেই আমি বড় ভেঙে পড়েছি ভাই!”
হলধর উঠে পায়চারি করতে করতে হাত নেড়ে বললেন, “বোগাস বোগাস, অল বোগাস। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন নগেনদা, বায়োলজিক্যাল নিয়মেই আপনার সেই সাধুবাবা অনেক আগেই কেঁসে গিয়েছে। এখন কোনও একটা ইম্পস্টার এসে আপনাকে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করছে। আপনি পুলিশে খবর দিন এবং ক্লাবের ছেলেদের অ্যালার্ট করুন। বেগতিক বুঝলেই সাধু পালাবার পথ পাবে না।”
এ কথায় নগেন বিশেষ ভরসা পেলেন বলে মনে হল না।
২. লম্বু দানু যে খুব ওস্তাদ ফুটবল খেলোয়াড়
লম্বু দানু যে খুব ওস্তাদ ফুটবল খেলোয়াড় তা নয়। সে ল্যাকপ্যাক করে লম্বা-লম্বা পায়ে ছোটে বটে, কিন্তু ড্রিবল করতে গিয়ে বারবার আছাড় খায় আর হি হি করে হাসে। বলে শট করতে গিয়ে উলটে পড়েও যায়। বেজায় লম্বা বলে তার হেড করা বল সব সময়েই বারের উপর দিয়ে চলে যায়। এসব নানা গোলমাল থাকলেও সে কিন্তু কাজের কাজটা ঠিকই করে দেয়। যখনই দল হারতে বসে তখনই ঠিক লম্বু দানু একটা-দুটো গোল দিয়ে দলকে জেতাবেই কী জেতাবে। আর এই জন্যই রায়পাড়ার শীতলা ক্লাবের সেক্রেটারি কাম কোচ কালীপদ ঘোষ ঠিক করেছেন, দানুকে হবিবপুর গ্রামের ইলেভেন টাইগার্সদের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি ম্যাচটায় খেলাবেন। তবে এই নিয়ে একটু বিতর্কও দেখা দিয়েছে। কারণটা হল, দানু শীতলা ক্লাবের মেম্বার তো নয়ই, এমনকী, রায়পাড়ার বাসিন্দাও নয়। তার চেয়েও বড় কথা, সে পায়েসপুরেও নবাগত। তার বাড়ি প্রতাপগড়ে। বাবা বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন বলে পায়েসপুরে এসে জুটেছে। সুতরাং হবিবপুরের ইলেভেন টাইগার্স যদি বুঝতে পারে যে, শীতলা ক্লাব একজন বহিরাগতকে খেলাচ্ছে, তা হলে ম্যাচ বাতিল হয়ে হবিবপুর ওয়াক ওভার পেয়ে যেতে পারে। সুতরাং দানুকে খেলানো উচিত হবে কি না সেই নিয়ে ক্লাব-কর্তৃপক্ষ এখনও পাকা সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।
শীতলা ক্লাবের ফুটবল ক্যাপ্টেন প্রাণারাম অবশ্য দানুকে খেলানোর পক্ষে। কারণ, দানু বলতে গেলে তারই আবিষ্কার, মাস দুই আগে একদিন সন্ধেবেলা তার পড়ার ঘরের জানালা দিয়ে একটা ঝাঁকড়া চুলওয়ালা ঢ্যাঙা ছেলেকে উঁকি দিতে দেখে সে ভারী চমকে গিয়েছিল। প্রাণারাম চেঁচিয়ে উঠেছিল, “কে! কে রে তুই?”
ছেলেটি বড়-বড় দাঁত বের করে হেসে বলল, “কিছু কাজটাজ করে দিতে হবে?”
“কাজ! কীসের কাজ?”
“যে-কোনও কাজ।”
“কাজ করতে চাস কেন?”
“কাজ করলে চাট্টি খেতে পাওয়া যায়। নইলে তো কেউ খেতে দেয় না। তাই কাজ খুঁজছি।”
শুনে প্রাণারামের একটু দয়া হল। সে চুপিচুপি রান্নাঘর থেকে কয়েকটা রুটি আর একটু গুড় এনে দিল। ছেলেটি বারান্দায় বসে খুব যত্ন করে রুটি খেল। প্রাণারাম বলল, “তুই কী কী কাজ করতে পারিস?”
“যা বলবে সব করে দেব।”
“আমার পিসির বাড়িতে মস্ত একটা ভীমরুলের চাক হয়েছে। কেউ ভয়ে সেটা ভাঙতে পারছে না। ভেঙে দিতে পারবি?”
ছেলেটা ঘাড় কাত করে বলল, “খুব পারব। এ তো সোজা কাজ। আমি অনেক ভীমরুলের চাক ভেঙেছি।”
“ঠিক আছে, কাল সকালে আসিস।” ছেলেটি রাজি হয়ে চলে গেল এবং পরদিন সকালে ঠিক এসে হাজির হল। প্রাণারামের পিসি সরযূদেবী অনাথা বিধবা। ছেলেপুলে নেই। বিরাট বাড়িটায় একা থাকেন।
সরযূদেবীর দোতলার বারান্দায় ভীমরুলের বিশাল চাকটা দেখলে ভয় হওয়ারই কথা। প্রায় দু’ হাত লম্বা আর থামের মতো মোটা মেটে রঙের চাক। সর্বদাই ভীমরুলরা ভনভন করছে চারদিকে। কিন্তু দানু বিন্দুমাত্র ঘাবড়াল না। নারকেলের ছোবড়া জ্বেলে ধোয়া তৈরি করে আধঘণ্টার মধ্যে ভীমরুলদের চাকছাড়া করে দা দিয়ে চাকটা কেটে পুকুরপাড়ে নিয়ে গিয়ে ভেঙে ফেলল।
পিসি ভারী খুশি হয়ে দু’টো টাকা দিতে গেলেন, কিন্তু দানু নিল। বলল, “দুপুরে দুটো ভাত দেবেন, তা হলেই হবে।”
পিসি বললেন, “তা দেব বাবা।”
প্রাণারাম বলল, “ও পিসি, দানু তো বাপে তাড়ানো ছেলে! ওকে তোমার কাছেই রেখে দাও না কেন?”
পিসি একটু সন্দিহান হয়ে বললেন, “চোরাচোড় নয় তো?”
কথাটা দূর থেকেও কী করে যেন শুনতে পেল দানু। একগাল হেসে বলল, “না পিসি, আমি চোরাচোড় নই। ঘরদোরে থাকতে না দেন তো নীচের বারান্দাতেই পড়ে থাকতে পারি।”