নগেন সর্বাধিকারী খুবই অপ্রস্তুত হয়ে হঠাৎ ব্যস্তসমস্তভাবে কোঁচা ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন, “উঠি হে হলধর, ওদিকে আবার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
সবাই হইহই করে উঠলেন। নিমাই বিশ্বাস উঠে সদর দরজার ছিটকিনি এঁটে তাতে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, “উঁহু, অত সহজে ছাড়া পাবেন না নগেনদা! ব্যাপারটা খোলসা করে বলুন। যদি কোনও বিপদআপদ হয়ে থাকে, তো আমরা আছি কী জন্য? সব খুলে বলুন, আমরা জান লড়িয়ে দেব।”
নগেনবাবু খুব অসহায় মুখ করে ফের বসে পড়লেন। নগেনবাবু আমুদে লোক হলেও ভারী নিরীহ আর ভীতু মানুষ। বসে ভারী জলে-পড়া ভাব করে সকলের মুখের দিকে চাইতে লাগলেন। তারপর গলাখাকারি দিয়ে বললেন, “আমার সত্যিই বড় বিপদ।”
“আহা, সেটাই তো সবাই শুনতে চাইছি।”
“কিন্তু বলায় যে বারণ আছে?”
“কার বারণ?”
“তাকে তোমরা চিনবে না। তবে সে বড় ভয়ংকর লোক।” নিমাই বিশ্বাস বললেন, “এ গাঁয়ে বা আশপাশে যারা আছে তাদের নাড়িনক্ষত্র আমি জানি। ষণ্ডা-গুন্ডা নেই তা বলছি না, কিন্তু ভয়ে মুখে কুলুপ এঁটে থাকতে হবে এমন মারকুট্টা তো কাউকে মনে পড়ছে না।”
“না না, সে এদিককার লোকই নয় হে! আজকের লোকও নয়। সে পঁচাত্তর বছর আগে এসেছিল।”
ব্ৰজেন বোস চোখ কপালে তুলে বললেন, “বলো কী হে! পঁচাত্তর বছর আগে এসেছিল। তা হলে তো সে থুথুড়ে বুড়ো মানুষ!”
নগেন সর্বাধিকারী মাথা নেড়ে বললেন, “না হে ব্ৰজেন, সে মোটেই বুড়ো নয়। বেশ তাগড়াই জোয়ান চেহারা।”
নিমাই বিশ্বাস অবিশ্বাসের হাসি হেসে বললেন, “জোয়ান চেহারা বলছেন। পঁচাত্তর বছর আগে তার কত বয়স ছিল?”
“তা ধরো পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন তো হবেই।”
“তা হলে হিসেবে দাঁড়ায়, তার বয়স এখন একশো পঁচিশ থেকে তিরিশ। বেঁচে থাকারই কথা নয়। আর যদিও-বা বাইচান্স বেঁচে থাকে, তা হলে তার খুনখনে বুড়ো হয়ে যাওয়ার কথা!”
নগেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “সেটাই তো চিন্তার কথা!”
“আপনি লোকটাকে ভয় পাচ্ছেন কেন তা বুঝতে পারি না। পঁচাত্তর বছর আগের কোনও লোক কী করে এসে আপনাকে ভয় দেখাচ্ছে?”
“তার আসবার কথাই ছিল। সে বাবাকে বলে গিয়েছিল ঠিক পঁচাত্তর বছর পরে সে এসে জিনিসটা ফেরত নিয়ে যাবে।”
“জিনিস! কী জিনিস বলুন তো?” নগেন সর্বাধিকারী একটু চুপ করে রইলেন। তারপর গলাটা একটু চেপে বললেন, “তা হলে তোমাদের সব খুলেই বলতে হয়। তখন আমার বয়স বছর দশেক। তখন আমরা বড্ড গরিব ছিলুম। সামান্য জমিজমা থেকে যে আয় হত তাতে গ্রাসাচ্ছাদন চলত না। ভাঙা ঘরে বাস, আধপেটা খাওয়া বা উপোস, জামাকাপড়, জুতো, ছাতা সবই অমিল। ঠিক সেই সময় একদিন দুপুরের দিকে এক পেল্লায় চেহারার, জটাজুটধারী, রক্তাম্বর পরা সাধু গোছের লোক এসে হাজির। অভাবে পড়ে তখন আমাদের এমন অবস্থা যে, দৈবের উপর বড় বেশি নির্ভরতা এসে গিয়েছিল। সাধু দাওয়ায় বসে বাবার সঙ্গে কিছু কথাটথা কইল, মনে আছে, একঘটি জলও খেল ঢকঢক করে। তারপর ঝোলা থেকে একটা জিনিস বের করে বাবার হাতে দিয়ে বলল, “তোকে এটা দিয়ে যাচ্ছি। যদি ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারিস, তা হলে বেঁচে যাবি। যদি লোভ করিস, তবে মরবি। আরও একটা কথা, ঠিক পঁচাত্তর বছর পর আমি আমার জিনিস ফেরত নিতে আসব। যদি জিনিসটা বেহাত হয় বা হারিয়ে যায়, তা হলে কিন্তু নির্বংশ করে দিয়ে যাব। তোর ছেলেপুলে বা বংশধরদের হুশিয়ার করে দিস!“
হলধর বললেন, “এ তো হিন্দি ছবির গপ্পো!” গজপতি বলে উঠলেন, “আরে না না, এ হল আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের বৃত্তান্ত। না নগেনদা, এ জিনিস চলবে না।”
নগেন পাংশু মুখে বললেন, “এই জন্যই বলতে চাইছিলাম না। জানি তোমাদের বিশ্বাস হবে না! তা হলে এই পর্যন্তই থাক!”
ব্ৰজেন বললেন, “আরে চটো কেন ভায়া? আমার তো দিব্যি বিশ্বাস হচ্ছে। কেউ কথা কইলেই ওদের ফুট কাটার স্বভাব।”
নিমাই অবাক হয়ে বললেন, “আমি তো হাঁ করে শুনছি। গায়ে কাটাও দিচ্ছে, এই দেখুন!”
খগেন বললেন, “আমারও তো বাপু মোটেই অবিশ্বাস হচ্ছে না।”
নগেন ফের একটা বড় শ্বাস মোচন করে বললেন, “বিশ্বাস করা না-করা তোমাদের ইচ্ছে। যা ঘটেছিল তাই বলছি।”
সবাই সমস্বরে সম্মতি জানালে নগেন বললেন, “গজপতি ঠাট্টা করলেও কথাটা ভুল বলেনি। সাধুবাবা একটা প্রদীপই দিয়েছিল বাবাকে, ছোট্ট, এই আমার মুঠোর সমান মাপের একটা পেতল বা ওই ধরনের ধাতুর প্রদীপ।”
নিমাই সাগ্রহে বললেন, “সোনার নয় তো?”
“তাও হতে পারে। যাচাই করে দেখা হয়নি। কারও হাতে দেওয়া বারণ ছিল। শুধু বাবাই ওটা নিয়ে ঘর বন্ধ করে কী সব প্রক্রিয়া করতেন। আগেই বলে রাখি, আমরা প্রদীপ থেকে কোনও দৈত্যদানো বেরিয়ে আসতে দেখিনি, রাতারাতি বড়লোকও হয়ে যাইনি। প্রদীপটা বাবার হাতে আসার পর কিন্তু ধীরে ধীরে আমাদের অবস্থার উন্নতি হতে লাগল। খাওয়া-পরার এত কষ্ট আর ছিল না। বাবা পুরনো ভদ্রাসন ছেড়ে নতুন পাকাবাড়ি করে উঠে এলেন।”
হলধর বিরক্ত হয়ে বললেন, “বোগাস ব্যাপার। প্রদীপের সঙ্গে আর্থিক উন্নতির সম্পর্কটা কী? এসব তো রূপকথার গল্প।”
নগেন মিইয়ে গিয়ে বললেন, “ওই জন্যই তো বলতে চাইনি। তোমাদের চাপাচাপিতে বলতে হল। এ গপ্পো বিশ্বাস না করো ক্ষতি নেই, কিন্তু একথা অতি নির্জলা সত্যি যে, সেই সাধুবাবা ঠিক পঁচাত্তর বছর পর ফিরে এসেছে।”