নিমাই বিশ্বাস মাথা নেড়ে বললেন, “আরে না, না। নগেনদা বলল, সবরিকলা।”
গজপতি একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন, “দুর-দুর, নগেনদা স্পষ্ট বলেছেন পালকিওয়ালা।”
ব্ৰজেন বোস বললেন, “আমি যেন ডাল মে কালা শুনলাম।”
হলধর বিরক্ত হয়ে বললেন, “আহা, আপনাদের সবতাতেই হুড়োহুড়ি। নগেনদা তো আর যোবা নন, নিজেই বলবেন’খন। একটু সবুর করুন।”
নগেনবাবু ভারী বিস্মিত হয়ে সকলের মুখে চোখ বুলিয়ে বললেন, “কিছু বলেছি নাকি?”
নিমাই বিশ্বাস জোরের সঙ্গে বললেন, “আলবাত বলেছেন। দু’ দিনের মৌনী ভেঙে এই তত প্রথম কথা ফুটল আপনার।”
নগেন চিড়ে চিবোতে-চিবোতে বললেন, “তা হবে হয়তো। কিন্তু কী বলেছি সেটা আমারও আর মনে নেই।”
খগেন তপাদার চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, “কাবলিওলাটাকে আমিও দেখেছি বটে, তবে অনেকটা দূর থেকে। পরশু সকালের দিকে যখন খেতের কাজ তদারক করে ফিরছিলুম, তখন দূর থেকে যেন দেখলুম, ঝোলা কাঁধে দুলকি চালে ব্যাটা বটতলার মোড় থেকে বাঁ দিকে ঘুরে গেল। বেশ ময়লা জামাকাপড়, আর তেমন লম্বা-চওড়াও নয়।”
হঠাৎ অস্ফুটস্বরে নগেন সর্বাধিকারী ফের কী একটা বলে উঠলেন।
নিমাই ঝুঁকে পড়ে বললেন, “কে এসে গিয়েছে? কার কথা বলছেন, ও নগেনদা?”
নগেনবাবু তাড়াতাড়ি গরম চায়ে চুমুক দিয়ে ভারী অবাক হয়ে বললেন, “কই বাপু, কিছু তো বলিনি!”
নিমাই দমে গিয়ে বললেন, “স্পষ্ট শুনলুম যে!”
অন্য সবাইও প্রায় সমস্বরে বলে উঠল, “আমরাও তো শুনেছি!”
নগেন উদাস হয়ে বললেন, “ওরে বাপু, পঁচাশি বছর বয়স হল, এখন দু-চারটে কথা মুখ ফসকে বেরিয়ে যেতেই পারে। ও কিছু নয়।”
খগেন তপাদার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “নাঃ, ওই সাধুবাবাই কিছু একটা তুকতাক করে গিয়েছে দেখছি। নইলে নগেনদার মতো একটা হাসিখুশি লোক কী রাতারাতি আঙুর থেকে আমসি হয়ে যেতে পারে?”
হলধর ধমক দিয়ে বললেন, “তোমাদের মতো দুর্বলচিত্ত আর কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকেদের জন্যই আজও বুজরুকরা করে খাচ্ছে, বুঝলে? তুকতাকে যদি কাজ হত তা হলে আর সায়েন্সের দরকারই হত না।”
গজপতি বললেন, “আহা, চটো কেন ভায়া? তুকতাকটা কথার কথা। আমরা কেউ ওসবে মোটেই বিশ্বাস করি না। সায়েন্সেই আমাদের অচলা ভক্তি। নইলে সকাল থেকে এসে তোমার বাড়িতে ধরনা দিই কেন?”
হলধর ফুঁসে উঠে বললেন, “আপনি আর সাধু সাজবেন না। এই তো মাসখানেক আগে বগলামুখী কবচ আর রক্তপ্রবাল ধারণ করলেন, গেলবার শ্মশানকালীর সোনার নথ গড়িয়ে দিয়েছিলেন, গত সপ্তাহেও আপনার বাড়িতে সত্যনারায়ণ পুজো হয়েছে।”
গজপতি একগাল হেসে বললেন, “তা ভায়া, সত্যনারায়ণ পুজো না হয় খারাপ, কিন্তু তুমি যে সত্যনারায়ণের একটি সিন্নি বেশ চেটেপুটে খেলে?”
“সিন্নি খেতে অতি চমৎকার, তাই খেয়েছি। সত্যনারায়ণের প্রসাদ বলে তো আর খাইনি।”
ব্ৰজেন বোস বলে উঠলেন, “আমারও সেই কথা। নাস্তিক বলে কি সিন্নি খাব না? গজপতির বাড়ির সিন্নিটা হয়ও ভারী চমৎকার।”
হলধর চোখ রাঙিয়ে বললেন, “আপনি আর বলবেন না তো! আপনি আবার কবে থেকে নাস্তিক হলেন? হরিসভায় বসে কীর্তন শোনেন, শনিমন্দিরে গিয়ে রোজ সন্ধেবেলা নমো ঠোকেন, প্রতি বেস্পতিবার আপনার বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো হয়। নাস্তিক হতে বুকের পাটা চাই মশাই। ভণ্ডামি করে নাস্তিক হওয়া যায় না।”
ব্ৰজেন ভারী আহ্লাদের গলায় বললেন, “আহা, আমি তো সেই কথাই বলতে চাইছি। এই হরিসভায় বা শনিমন্দিরে যাওয়া বা বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো করা, এসব হল ভণ্ডামি, ভিতরে-ভিতরে আমি খুব নাস্তিক।”
ঠিক এই সময় নগেনবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “উঃ, পঁচাত্তর বছর পর!”
এ কথাটা সকলেই বেশ স্পষ্ট শুনতে পেলেন। কথাবার্তা থামিয়ে সবাই অবাক হয়ে নগেনবাবুর দিকে তাকিয়ে আছেন। নিমাই বিশ্বাস বলে উঠলেন, “পঁচাত্তর বছর পর কী নগেনা?”
নগেন সর্বাধিকারী ভারী অপ্রতিভ হয়ে চারদিকে মিটমিট করে চেয়ে মাথা নেড়ে বললেন, “না না, ও কিছু নয়!”
নিমাই বিশ্বাস চেপে ধরলেন, “কিছু নয় বললে তো শুনব না নগেনদা। পঁচাত্তর বছর পর’ কথাটার মানে কী?”
নগেন সর্বাধিকারী ভারী জড়সড় হয়ে চারদিকে টালুমালু করে তাকাতে-তাকাতে বললেন, “না, এই বলছিলাম আর কী যে, পঁচাত্তর বছর বেশ লম্বা সময়। তা নয় কি?”
“তা তো বটেই। কিন্তু আপনার তা নিয়ে সমস্যা হচ্ছে কেন?”
ভারী অবাক হয়ে নগেনবাবু বললেন, “আমার সমস্যা! না না, আমার সমস্যা কীসের?”
গাঁয়ে গোয়েন্দাগিরিতে খগেন তপাদারের একটু খ্যাতি আছে। কোথাও চুরিটুরি হলে বা কারও বাড়িতে কিছু খোয়া গেলে, গোরু, ছাগল হারালে বা সন্দেহজনক কিছু ঘটলে খগেন তপাদারের খোঁজ পড়ে। বলতে নেই, খগেন তপাদার কিছু চুরি জোচ্চুরির হিল্লে করে দিয়েছেন। অন্তত এক ডজন গোরু এবং গোটা পঁচিশেক ছাগলের হদিশ করে দিয়েছেন। এই তো সেদিন ময়রাগিন্নির হারানো সোনার বালা তাদেরই পুকুর থেকে উদ্ধার করেছিলেন। পায়েসপুরের শালক হোমস তিনিই। খগেন এবার ছোট চোখে নগেনবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “শুধু পঁচাত্তর বছর পরই’ বলেননি, তার আগে ‘আপনি এসে গিয়েছে’ কথাটাও ব্যবহার করেছেন। তারও আগে বলেছেন ‘কাবলিওয়ালা বা ‘সবরিকলা বা ওই ধরনের কিছু। তিনটে কথাকে পরপর সাজালে পঁড়াচ্ছে, কাবলিওয়ালা এসে গিয়েছে পঁচাত্তর বছর পর। ঠিক কিনা নগেনা?”