সাধুবাবা মিটমিট করে একবার গাবু আর একবার গদাইয়ের দিকে চেয়ে দেখল। তারপর বজ্রগম্ভীর গলায় বলল, “আমার পিদিম দে।”
হোঃ হোঃ করে হেসে গাবু তার আলপাকার পোশাকের পকেট থেকে পিদিমখানা বের করে হাতের তেলোয় রেখে বলল, “এইটে চাই বুঝি তোমার?”
সাধু গমগমে গলায় বলল, “যার জিনিস তাকে ফেরত দে পাপী। নইলে কপালে কষ্ট আছে।”
“বটে! ওরে গোলাম, সাধুটাকে তুলে কয়েকটা আছাড় দে তো।”
দৈত্য চকিতে এগিয়ে এসে সাধুকে তুলে বিশাল জোরে মেঝের উপর আছড়ে ফেলল। সেই আছাড়ের শব্দে কেঁপে উঠল গোটা বাড়ি। গোটাপাঁচেক আছাড়ের পর গাব্বু বলল, “যাক, আর নয়। কী সাধু, পিদিম চাই?”
“চাই, দে। নইলে তোর সব যাবে। পিদিমের জোরে যদি রাজা হতে চাস, তবে লোকে তোর গায়ে থুথু দেবে। এই সব ভোজবাজির আয়ু বেশি দিন নয়। এখনও সময় আছে। পিদিম ফেরত দে।”
“এই দিচ্ছি। ওরে গোলাম, ওর ত্রিশূল দিয়েই ওকে ছুঁড়ে দে তো। এ-ফোঁড় ওফোঁড় করে তবে ছাড়বি।”
গদাই সভয়ে চোখ বন্ধ করে চিৎকার করল, “না! না!”
দৈত্য বিনা দ্বিধায় শূলটা তুলে নিয়ে সাধুর বুকে ভীমবেগে বসিয়ে দিল। সাধুকে ভেদ করে পিঠ থেকে শুলের ডগা বেরিয়ে রইল।
সাধু ফের অবিচল কণ্ঠে বলল, “তোর মনস্কামনা পূর্ণ হওয়ার নয়। আমার মরার যখন সময় হবে তখনই আমি মরব। ইচ্ছামৃত্যু। তার আগে কারও হাতেই আমার মরণ নেই। পিদিমটা দে।”
গাব্দুর মুখ হাঁ, চোখ বিস্ফারিত। সে যে ভয় পেয়েছে তাতে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। তোতলাতে-তোতলাতে সে বলল, “তু-তুমি মরলে না?”
সাধু একটানে শূলটা বের করে বলল, “দে।”
গাল্লু পিদিমটা হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে বিকট চিৎকার করে বলতে লাগল, “গোলাম, ওকে মেরে ফ্যাল, শিগগির মেরে ফ্যাল! যেমন করেই হোক মেরে ফ্যাল।”
কিন্তু হঠাৎ সাধু বিদ্যুৎ-বেগে শূলটা ছুঁড়ে দিল গাবুর দিকে। সেটা নিখুঁত নিশানায় তার ডান হাতের কবৃজি ভেদ করে যেতেই পিদিমটা ঠং করে পড়ে গেল মেঝেয়। ঝাঁপিয়ে পড়ে সেটা অতি তৎপরতায় তুলে নিল গদাই। তারপর চোখ পাকিয়ে দৈত্যের দিকে চেয়ে বলল, “চুপচাপ ঘরের কোণে গিয়ে হাঁটুগেড়ে বসে থাক।”
দৈত্য বলল, “জো হুজুর। তারপর গিয়ে ঘরের কোণে হাঁটু মুড়ে বসল।”
সাধু জ্বলজ্বলে চোখে গাব্বুর দিকে চেয়ে হাত তুলে বলল, “পুনর্বিগত ভবঃ।”
হঠাৎ ঘরদোর সব মিলিয়ে গেল। দেখা গেল একটা দীন-দরিদ্র খোড়োঘরে তারা রয়েছে। গদাই চোখ কচলে বলল, “বাবা, এসব কি হাওয়াবাজি ছিল নাকি?”
“দুনিয়ার সব কিছুই হাওয়াবাজি রে ব্যাটা। যত তাড়াতাড়ি তোর জ্ঞান হবে তত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবি।”
গাঙ্কু কবজি চেপে ধরে কাতরাতে-কাতরাতে অবিশ্বাসের চোখে সাধুবাবার দিকে চেয়ে ছিল। হিংস্র গলায় বলল, “আমার পিদিম কেড়ে নিয়েছ! ওরে গোলাম, পিদিমটা উদ্ধার করে আমাকে দে।”
গোলাম নড়লও না। সাধু বলল, “আমার কাজ শেষ হয়েছে। আমি যাচ্ছি। শোক কোরো না। ও পিদিম তোমার নয়, আর ও জিনিস হজম করার ক্ষমতাও তোমার নেই। কয়েক দিনেই সারা এলাকার সর্বনাশ করতে বাকি রাখোনি। বাকি জীবন আধপেটা খেয়ে থাকবে, এই তোমার শাস্তি।”
তারপর সাধু গদাইয়ের দিকে ফিরে বলল, “এই খাড়া দুপুরে এতটা পথ হেঁটে ফিরতে পারব না রে বাপু। দত্যিটাকে বল, একটু পৌঁছে দিক।”
জিভ কেটে গদাই তাড়াতাড়ি পিদিমখানা সাধুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “আপনি বলুন বাবা, জীবনে কখনও দাসদাসী খাটাইনি তো। ও আমার সইবে না।”
সাধু একটু হাসল।
দৈত্যের পিঠে চেপে এক লহমায় প্রতাপগড়ের জঙ্গলে শিবমন্দিরের চাতালে পৌঁছে গেল তারা।
সাধুবাবা দৈত্যকে বলল, “তোর কাজ শেষ হয়েছে বাবা, এবার পিদিমের ভিতরে গিয়ে ঘুমিয়ে থাক।”
“যথা আজ্ঞা মহারাজ।” বলেই দৈত্যটা একেবারে ধোয়াক্কার হয়ে গিয়ে পাক খেয়ে-খেয়ে সুতোর মতো সরু হয়ে সুড়সুড় করে পিদিমের মধ্যে ঢুকে মিলিয়ে গেল।
পিদিমখানা ঝোলায় পুরে সাধুবাবা বলল, “ওই তিনটে লোকের বাঁধন খুলে দে বাপু। এই ওষুধটা খাইয়ে দে। আমি রওনা দেব রে!”
“সে কী বাবা! এখনই যাবেন কি? আমার যে সাধন-ভজন শেখা এখনও অনেক বাকি।”
সাধুর দাড়ি-গোঁফের ফাঁক দিয়ে এবার একটু হাসি দেখা গেল। বলল, “সাধন-ভজন কী আর একরকম রে? নানাজনের নানারকম। লোভটোভ করিসনি বাবা, দুনিয়াটাকে একটু ভালবাসিস, আমাকে মনে রাখিস, আর শোন, অল্পে আনন্দ পেতে শিখে নিস। তোর ওতেই হবে রে। আর এই আমার ঝোলাখানা আজ থেকে তোর কাঁধে ঝুলবে।”
“উরেব্বাস রে! ওতে যে ওই সব সাংঘাতিক জিনিস আছে?”
“তা আছে। পরশপাথর, আশ্চর্য পিদিম, উড়ুক্কু গালিচা আর অক্ষয় থালা। দুনিয়ার সব ঐশ্বর্য তোর হাতের নাগালে রেখে গেলাম। আজ আর আমার কোনও ভার নেই।”
“আমি কিন্তু বেশ লোভী লোক বাবা?”
“তা আমি জানি। তুই লোভী, পেটুক, একটু ঘড়েল। তবু এই কলিযুগের পক্ষে তুই তেমন খারাপ লোক নোস। কত লোককেই তো কত জিনিস দিয়ে নিরপরখ করলাম। তোকেও না হয় একটু বাজিয়ে দেখা যাক।” তারপর সাধু হাত তুলে বলল,
“আনন্দম!”
সাধু চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ মনটা বড় খারাপ হয়ে রইল গদাইয়ের। তার পর সে ধীরে-সুস্থে বটেশ্বর, রাধাগোবিন্দ আর দানুর বাঁধন খুলল, তাদের ওষুধ খাওয়াল। জ্ঞান ফেরার পর তাদের হটিয়ে নিয়ে জঙ্গলের সীমানা পার করে দিয়ে এল।