“কী চাই?”
“না, বিশেষ কিছু চাইতে আসা নয়। গাব্বুদাদার সঙ্গে পুরনো চেনা তো! তা শুনলুম, গাব্বোয়া এখন অনেক উন্নতি করে ফেলেছে। তাই একটু দেখে গেলুম আর কী। তবে কিনা মশাই, কেউ উন্নতি করলেই পাঁচজনের বড় চোখ টাটায়। আড়ালে আবডালে কেউ-কেউ পিছনে লাগবারও চেষ্টা করে কিনা! তা গাব্বুয়া কি ঘুম থেকে উঠেছে মশাই?”
“আমার মনিব বিশ্রাম নিচ্ছেন। কারও দেখা করার হুকুম নেই।”
গদাইয়ের মুখ শুকনো। দৈত্যের চোখ এড়িয়ে ভিতরে যাওয়ার উপায় নেই। একেবারে তীরে এসে তরী বুঝি ডোবে! গদাই ঘাড় কাত করে বলল, “তা বিশ্রাম নেওয়াই উচিত। মেহনত বড় কম যায় না। আজও হয়তো রাতবিরেতে বেরোতে হবে।”
দৈত্য নিশ্চুপ। “আচ্ছা মশাই, আপনার কি সাধুবাবুকে মনে আছে? সেই যে, আপনি যখন ছোট্টটি ছিলেন, তখন সাধুবাবা আপনাকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াতেন, ঝিনুকে করে দুধ খাওয়াতেন, ছোট বাইরে বড় বাইরে পরিষ্কার করতেন। সেই যে লম্বা-চওড়া চেহারার মন্ত সাধু!”
“আমি কোনও সাধুকে চিনি না। আমি কখনও ছোট্ট ছিলাম না। আমি চিরকাল একই রকম।”
“বাঃ। তা হলে বোধ হয় ভুলই শুনেছি। তবে এটা জানি যে, সাধুবাবা আপনাকে খোঁজাখুঁজি করছেন। কারণটা ঠিক জানা নেই বটে। তবে মনে হল, আপনাকে ছাড়া তার বেশ কষ্ট হচ্ছে। শত হলেও মায়ার বাঁধন তো?”
“তুমি মিথ্যেবাদী।”
সঙ্গে-সঙ্গে ঘাড় কাত করে সায় দিয়ে গদাই বলল, “তা মিছে কথাও মাঝে-মাঝে বলে ফেলি বটে, তবে লোকের ভালর জন্যই
বলা। সেই সঙ্গে গাবুয়ার সঙ্গে একটু কাজের কথাও ছিল।”
“কী কথা?”
“সে বড় গুহ্য কথা।”
“আমাকে বলল। আমি তার হুকুমদাস।”
“ওরে বাবা, সে উপায় নেই মশাই। গুরুতর খবর, গাব্বুয়া ছাড়া আর কারও কাছে বলা যাবে না।”
“তুমি দাঁড়াও।” বলেই দৈত্য অদৃশ্য হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড পরেই আবার ফস করে সামনে ফলিত হয়ে বলল, “ভিতরে এসো।”
ভিতরে দিব্যি সব ব্যবস্থা। ভাল-ভাল চেয়ার, টেবিল, আরামকেদারা, দেওয়ালগিরি, দামি গালিচা। টেবিলে থরেথরে আপেল, আঙুর, বেদানা মজুত। শরবত-টরবতও আছে, দেখা গেল।
একটা সিংহাসনের মতো চেয়ারে পোশাক পরা গাব্বু ঘাড় হেলিয়ে বসা! চুল এলোমেলো, চোখ দুটো যেন লাল, মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ এবং ক্লান্তি। গদাইয়ের দিকে ক্রুর চোখে চেয়ে বলল, “তুমি কে?”
গদাই ভারী বিনয়ের সঙ্গে বলল, “ভুলে গেলে নাকি ভাই? আমি হলুমগে গদাই।”
কাহিল চোখে চেয়ে থেকে বেশ ক্লান্ত গলায় গাম্বু বলল, “তুমি জড়িবুটিওলা গদাই না?”
গদাই একগাল হেসে বলল, “এই তো ভাইটির মনে পড়ে গিয়েছে। আমার তো ভয় ছিল, বড়মানুষ হয়ে আমাকে বোধ হয় চিনতেই পারবে না! তা ভায়া, তোমার উন্নতি দেখে ভারী খুশি হলুম। কিন্তু তোমার চেহারাটা তেমন ভাল দেখছি নাশরীরটা কি খারাপ যাচ্ছে? খুব হয়রান হয়ে পড়োনি তো!”
গাবু অধৈর্য ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বলল, “আঃ! বাজে কথা ছাড়ো। এখন বলো তো, কী মতলবে এসেছ?”
গদাই একটু থমমত খেয়ে ফের বিগলিত হয়ে বলল, “মতলবেই আসা বটে, তবে মতলব কিছু খারাপ নয় রে ভাই। বলতে এলুম যে, জীবনে উন্নতি করলেই তো হল না, সেইসঙ্গে পথের কাঁটাও তো নিকেশ করা চাই, নাকি?”
গাব্বু সোজা হয়ে বসে বলল, “কে আমার পথের কাঁটা?”
“দ্যাখো ভাই, তোমার ভাল ভেবেই কষ্ট করে হাঁফাতে-হাঁফাতে এত দূর এসেছি। তাও তো তোমার পাহারাদার আমাকে গলাধাক্কাই দিচ্ছিল আর কী?”
“কিছু মনে কোরো না ভাই। চারদিকে আমার বিরুদ্ধে নানারকম যড়যন্ত্র হচ্ছে বলে খবর পেয়েছি, তাই সাবধান হতে হয়েছে। এবার বলো।”
“বলি, গলা ভিজনোর জন্য একটু জল পাওয়া যাবে কি?”
“আহা, জল কেন, ভাল শরবত আছে, খাও। ওরে গোলাম, শরবত দে।”
দৈত্যটা চট করে এক গেলাস শরবত এনে দিল। মুখে দিয়েই গদাই বুঝল এ বড় উঁচু জাতের জিনিস, জন্মেও এরকম কখনও খায়নি। তবে তার জল বা শরবতের দরকার ছিল না। কী বলবে সেটা এঁচে নিতে একটু সময়ের দরকার ছিল মাত্র। শরবত খেতে খেতেই সে বয়ানটা গুছিয়ে ফেলল।
তারপর গেলাস রেখে জামায় মুখ মুছে গলাটা খাটো করে বলল, “খবরটা ঠিকই পেয়েছ ভায়া। তোমাকে নিকেষ করে পিদিমটা কেড়ে নেওয়ার একখানা পাকা ছক কষা হয়ে গিয়েছে।”
“কে? কার এত সাহস?”
“প্রতাপগড়ের জঙ্গলে একটা ভাঙা শিবমন্দির আছে জানো তো?”
“জানি।”
“সেখানে ক’দিন হল এক সাধু আস্তানা গেড়েছে। পেল্লায় চেহারা। সাক্ষাৎ নরখাদক। সে পিদিমটার সন্ধানেই এসেছে। তার মেলা চেলা-চামুণ্ডা। ভূত-প্রেতও তার বশ। যদি সাবধান না হও, তা হলে পিদিম রক্ষে করতে পারবে না।”
গাব্দু একটা অট্টহাসি হেসে পাশের একটা সোনার পাত্র থেকে একমুঠো মোহর তুলে তার হাতে দিয়ে বলল, “এই নাও বখশিস। সাধুর জারিজুরি কী করে ভেঙে দিই তাও দ্যাখো। ওরে গোলাম, যা, গিয়ে প্রতাপগড়ের জঙ্গলের ভাঙা শিবমন্দির থেকে সাধুটাকে ধরে নিয়ে আয়।”
দৈত্য হুশ করে অদৃশ্য হল। এবং এক লহমায় ফিরে এল। ঘাড় ধরে সাধুকে নিয়ে এসেছে। সাধু ত্রিশূলটা অবধি রেখে আসার ফুরসত পায়নি। সেটা এখনও এক হাতে ধরা। সাধুকে গাবুর সামনে নামিয়ে দিয়ে সে সসম্ভ্রমে সরে দাঁড়াল।
গাব্দু সাধুর দিকে রক্তচোখে চেয়ে বলল, “কী হে সাধুবাবাজি, তোমার মতলবখানা কী?”