“সে তোদের কাছে। আমার কাছে ও তো চোখের পলক ফেলার সমান।”
“কিন্তু বাবা, এই কেষ্টর জীবগুলোকে এইভাবে কষ্ট দেওয়া ঠিক হচ্ছে? এদের মধ্যে কোনটা পিদিমের দানো সেটা তো মন্ত্রবলে ধ্যানযোগেই আপনার জানবার কথা।”
“ওইখানেই তো হয়েছে মুশকিল। কী জানিস, মাথার যে প্রকোষ্ঠে মন্তরগুলো থাকে, ইদানীং দেখছি, সেটা একটু ফঁকা-ফাঁকা ঠেকছে। কিছু-কিছু মন্তর কোন ফাঁকে যেন বেরিয়ে গিয়েছে।”
গদাই চোখ বড়-বড় করে বলল, “তা হলে তো সর্বনাশ! মন্তর পালিয়ে গিয়ে থাকলে উপায় কী হবে বাবা?”
“আরে পালিয়ে যাবে কোথায়! বেশি দূর যায়নি, আশপাশেই ঘঘারাফেরা করছে। ওসব আমার পোষা মন্তর, গায়ে একটু হাওয়া লাগিয়ে ফের ঠিক ফিরে আসবে।”
“আমি খবর নিয়ে দেখেছি বাবা, যাদের বেঁধে রেখেছেন তাদের একজন পায়েসপুরের পালোয়ান বটেশ্বর, আর-একজন রিটায়ার দারোগা রাধাগোবিন্দ। তাদের বাড়িতে-বাড়িতে বড্ড কান্নাকাটি
হচ্ছে বাবা। আর তিন নম্বর দানুও বলেছিল বটে যে, সে মোটেই দানোটানো নয়। তার মৃগীর ব্যারাম ছিল। রমেশ কোবরেজ এক প্রাচীন পুঁথি থেকে নিদান বের করে পাঁচন গুলে খাওয়ায়। তাতে সে ঢ্যাঙা হয়ে পড়েছে, আর গায়ে খুব জোরও হয়েছে।”
সাধু গম্ভীর হয়ে বলল, “তোর কথায় বিশ্বাস কী? তুই ফন্দিবাজ মানুষ।”
“না বাবা, আপনার ভীমরতিটা দেখছি বেশ গেড়ে বসেছে। ভুল লোককে পাকড়াও করছেন, মন্তর ভুলে যাচ্ছেন, তৃতীয় নয়নে চালসে ধরেছে, এ যে বড় বিপদের কথা প্রভু! এরকম গুরু ধরে আমারই বা কী গতি হবে কে জানে বাবা?”
সাধু হুংকার দিয়ে বলল, “তুই অতি বজ্জাত!” কিন্তু হুংকারটা বড় মিয়নো শোনাল। অর্থাৎ ভুলভাল যে হচ্ছে, সেটা সাধু নিজেও টের পাচ্ছে।
গদাই সান্ত্বনা দিয়ে বলল, “আপনি তো কিছু এলেবেলে সাধু নন বাবা। ক্ষমতা বড় কম নেই আপনার। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে যখন ভুলচুক হচ্ছে তখন উপযুক্ত শিষ্যকে সব শিখিয়ে-পড়িয়ে দিলেই তো হয়। তারপর আপনি নিশ্চিন্তে হিমালয়ে গিয়ে লম্বা তপস্যায় বসে যান। ইদিকে আমি আপনার সব কাজকর্ম সামলে দিয়ে, লোককে নানারকম বুজরুকি দেখিয়ে একটু নামডাক করে ফেলি। তারপর আরও একটু বয়স হলে না হয় সাধন-ভজনে মন দেওয়া যাবে।”
সাধু গম্ভীর গলায় বলল, “তুই খুব ঘড়েল লোক।”
.
আজ সকালবেলায় পায়েসপুরে ঢুকেই গদাই ভারী অবাক হয়ে গেল। আগের দিন পায়েসপুরের আকাশে-বাতাসে, পাখির ডাকে দুঃখের ফুলঝুরি দেখে গিয়েছিল। আজ দুঃখের চেয়েও বেশি কিছু যেন চেপে বসে আছে পায়েসপুরের বুকে। সেটা শোক। পায়েসপুর একেবারে স্তব্ধ। গাছ নড়ছে না, কাক ডাকছে না, মানুষজন মাথা নত করে বসে আছে।
নগেনবাবু ধরা গলায় বললেন, “ওরে গদাই, পায়েসপুরের আর আশা নেই রে।”
হারাধনবাবু আবেগমথিত গলায় শুধু বলতে লাগলেন, “যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলল, তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ…,” ইত্যাদি।
ব্যাপারটা বুঝতে একটু সময় লাগল গদাইয়ের। তবে শেষ অবধি টুকরোটাকরা কথা, দীর্ঘশ্বাস, কোটেশন এই সব জুড়ে বোঝা গেল যে, গাব্বু নামে একটা গুন্ডা প্রদীপের দৈত্যকে নিয়ে চারদিকে দাপিয়ে বেড়াতে লেগেছে। তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বুকে ডুগডুগি বাজতে লাগল, উত্তেজনায় হাতে-পায়ে কাঁপুনি ধরে গেল।
গদাই দশগা ঘোরা লোক। গাব্বুর খবর করতে তার খুব বেশি দেরি হল না। রাঘবগঞ্জের খাল পেরিয়ে হিরাপুরের জঙ্গল! তার মাইলটাক উত্তরে বিদড়িহাটের সীমানায় একটা ফলসা জঙ্গলের মধ্যে গাব্বুর কুঁড়েঘর। বেলাবেলি রওনা হলে বড়জোর ঘণ্টাটাক লাগবে।
গদাই পা চালিয়ে রওনা হয়ে পড়ল।
ঘণ্টাটাক পর সে বিদড়িহাটের ফলসাবনে ঢুকে হাঁ হয়ে গেল। কোথায় কুঁড়েঘর! এ তো বেশ একখানা আঁকের বাড়ি! সামনে বাগান, বাগানে ফোয়ারা। ফুলটুলও ফুটে আছে মেলা। ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে সে খুব ভাল করে পরখ করল চারদিকটা। কেউ কোথাও নেই।
গদাই সাহস করে ঢুকে পড়ল ফটক ঠেলে।
সন্তর্পণে বারান্দায় উঠে কড়া নাড়তে যাবে বলে হাতটা বাড়িয়েছিল গদাই, ফস করে হঠাৎ সামনে উঁই কুঁড়ে একটা সাত আট হাত লম্বা আর অতিকায় চেহারার একটা লোক তার পথ জুড়ে দাঁড়াল। মেঘগর্জনের মতো গলায় বলল, “কী চাই?”
গদাই এমন ভড়কে গিয়েছিল যে, ধাত ছাড়ার উপক্রম। বুকের ধুকপুকুনি রেলগাড়িকে হার মানিয়ে এমন বেগে হতে লাগল যে, দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়।
একটু সামলে নিয়ে সে একগাল হেসে বলল, “প্রাতঃপ্রণাম, প্রাতঃপ্রণাম। তা শরীরগতিক সব ভাল তো?”
দৈত্যটা ভাবলেশহীন চোখে তার দিকে চেয়ে রইল শুধু। একটাও কথা বলল না।
হেঁ হেঁঃ করে হাত কচলাতে কচলাতে গদাই গলাখাকারি দিয়ে বলল, “যা শুনেছিলাম, আপনি দেখছি তার চেয়েও সরেস! আহা, কী শালগাছের মতো হাত! কী থামের মতো পা! ফুটবল মাঠের মতো কী বিরাট ছাতি! আর লম্বাটাও বলতে নেই, তালগাছকেও লজ্জা দেয়। আপনার কাছে কোথায় লাগে বটেশ্বর, কোথায় লাগে রাধাগোবিন্দ, আর ঢ্যাঙাদানু তো আপনার কোমরের কাছে পড়বে!”
দৈত্যের বিন্দুমাত্র হেলদোল নেই। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে, নিশ্চুপ।
“তা লোকে বলাবলি করছে বটে, হ্যাঁ, এত দিনে একটা মানুষের মতো মানুষ এসেছে বটে এ তল্লাটে! যেমন বুকের পাটা, তেমনই খ্যামতা। চারদিকে যে একেবারে ধন্যি-ধন্যি পড়ে গিয়েছে মশাই!”