খগেন তাড়াতাড়ি হারাধনকে একটা খোঁচা দিয়ে বললেন, “যাও না হে হারাধন।”
হারাধন চিড়বিড়িয়ে উঠে বললেন, “আমি! কভি নেহি!”
“আহা চুপ, চুপ। গলা নামাও। ইংরেজিতে গ্লোরিয়াস রিট্রিট বলে একটা কথা আছে, জানো?”
হারাধন মাথা নেড়ে বললেন, “এখন দেশের দুর্দিনে আপনি কি আমাকে ইংরেজি শেখাচ্ছেন? এখন কি ইংরেজির ক্লাস নেওয়ার সময়?”
“আহা, এটা হল স্ট্র্যাটেজি।”
হারাধন সমান তেজের সঙ্গে বললেন, “আপনার মতো ইংরেজের ধামাধরা কিছু লোক যে দেশকে আবার পরাধীন করতে চাইছেন, তা আমি জানি।”
নগেন সর্বাধিকারীই এগিয়ে গিয়ে দৈত্যের হাতে একটা টাকা দিয়ে খুব চাপা স্বরে বললেন, “তুমি একদিন আমাদেরই কাজের লোক ছিলে কিন্তু বাপু।”
দৈত্য নির্বিকার গলায় বলল, “এখন আর নই।”
গাঙ্কু সহাস্যে বলল, “তা হলে পায়েসপুরের হয়ে বশ্যতা স্বীকার করলেন তো নগেনবাবু?”
“হ্যাঁ বাবা, করলাম।”
পিছন থেকে কে যেন সরু গলায় বলে উঠল, “তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে।”
গাবু চিৎকার করে উঠল, “কে? কে বলল কথাটা?”
কেউ সাড়া দিল না। সবাই পাথরের মতো চুপ। গাব্বু সঁতে দাঁত ঘষে দৈত্যের দিকে চেয়ে হুকুম দিল, “এই ব্যাটা, কথাটা যে বলল তাকে ধরে আন তো!”
চোখের পলকে দৈত্য গিয়ে পিছনের সারি থেকে কাক করে একটা ছোঁকরাকে ঘাড় ধরে তুলে এনে গাব্বুর সামনে ফেলল।
গাব্বু জ্বলন্ত চোখে ছোঁকরার দিকে চেয়ে বলল, “কে তুই?”
নগেন সর্বাধিকারী কাঁপতে কাঁপতে উঠে জোড়হাতে বললেন, “ওকে মেরো না বাবা, আমি ওর হয়ে মাপ চাইছি। বয়সের দোষ তো, দুমদাম বলে ফেলে। ও আমার নাতি পান্টু।”
গাবু ধমক দিয়ে বলল, “আপনি বসুন। এই হারামজাদা পান্টু, এবার বল তো, কে আমাকে বধ করবে।”
পান্টু গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। জবাব দিল না। গাব্বু এগিয়ে গিয়ে ঠাস করে তার গালে একটা চড় কষিয়ে বলল, “কাপুরুষের মতো লুকিয়ে থেকে আওয়াজ না দিয়ে, বাপের ব্যাটার মতো সামনে এসে বলতে পারলি না, কে আমাকে বধ করবে? কার এত ক্ষমতা, কার এত বুকের পাটা? বল বদমাশ।”
আরও গোটাকয়েক চড় খেয়ে পান্টু কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলল, “আমি জানি না। এমনিই বলেছি।”
“তোর কাছে নিশ্চয়ই কোনও খবর আছে! বল, কে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। বল, নইলে এক্ষুনি গুলি করে মারব।”
গাব্বু তার পিস্তল তুলতেই একটা শোরগোল উঠল। সবাই বলতে লাগল, “ওকে মারবেন না! ওকে মারবেন না! এবারের মতো মাপ করে দিন!”
গাবু পিস্তল নামিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, “আমার আড়ালে যদি কেউ ষড়যন্ত্র করে তা হলে কিন্তু আমি ঠিকই খবর পাব। হুশিয়ার করে দিয়ে যাচ্ছি, কারও বদমতলব থাকলে সে কিন্তু রেহাই পাবে না। পায়েসপুরকে শ্মশান বানিয়ে ছাড়ব। মনে থাকে যেন।”
পায়েসপুরকে শাসন করে ঘোড়ায় চেপে টগবগ করে নিজের ডেরায় ফিরে এল বটে, কিন্তু গাব্বুর মনের মধ্যে একটা কাঁটা খচখচ করছে। সত্যিই কি তাকে কেউ বধ করার ষড়যন্ত্র করছে নাকি?
আজও রাত্রিবেলা তার বড় হলঘরে হুরি-পরিরা নাচ-গান করে তাকে খুশি রাখার চেষ্টা করছিল। কিন্তু মনটা ভাল নেই বলে সে হাতের ইশারায় তাদের বিদায় করে দিল। হুরি-পরি, গায়ক বাদকরা চোখের পলকে মিলিয়ে গেল। দেশ-বিদেশ থেকে ওস্তাদ বঁধুনিদের আনিয়ে তার জন্য বিশাল ভোজের ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু দুশ্চিন্তায় কিছুই মুখে রুচল না গাব্বুর। তার হাতের ইশারায় ভোজের টেবিল, বঁধুনি, সবই অদৃশ্য হয়ে গেল। সে দৈত্যকে ডেকে বলল, “কারা আমাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে খবর আন তো?”
দৈত্য এক লহমায় ঘুরে এসে বলল, “সবাই ষড়যন্ত্র করছে জাহাপনা।”
“সবাই?”
“হ্যাঁ মালিক।”
“সর্বনাশ!”
৬. সাধুবাবার ভীমরতি
সাধুবাবার ভীমরতি যে দিনদিন বাড়ছে বই কমছে না, সে বিষয়ে গদাইয়ের কোনও সন্দেহ নেই। এখন তিন-তিনটে দানো শিবমন্দিরের চাতালে বাঁধাছাদা হয়ে পড়ে আছে। কারও চেতনা নেই। আরক খাইয়ে তাদের ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। সাধুবাবা তাদের দিকে আড়ে-আড়ে চায়, আর মাথা চুলকোয়। বোঝা যায়, বাবাজি কিছু ধন্দে পড়েছে।
গদাই একদিন সকালবেলায় জিজ্ঞেস করল, “তা হাঁ বাবা, এত দিনেও কী সাব্যস্ত করা গেল না? কোন দানোটা আসল, আর কোনটা নকল? ত্রিকালদর্শী মানুষ আপনি, মন্তরের এত জোর, ধ্যানে বসলে শরীর হালকা হয়ে তিন হাত শূন্যে উঠে বসে থাকেন–নিজের চোখেই দেখেছি। তা আপনার মতো সাধকেরও যদি ভীমরতি হয়, তা হলে আমাদের মতো পাপী-তাপীর কোন দুর্গতি হবে কে জানে!”
সাধুবাবা একটু ভোমতোলা চোখে চেয়ে থেকে বলল, “তা গণ্ডগোল একটু হচ্ছে বাপু। দেহ ছাড়ার সময় হলে বিভূতিগুলো একটু-একটু করে দেহ ছেড়ে পালাতে থাকে কিনা!”
গদাই একটু আশার আলো দেখে ভারী গদগদ গলায় বলল, “দেহ ছাড়ার সময় কি এসে গেল নাকি বাবা? তা হলে আপনার জিনিসগুলোর একটা বিলিব্যবস্থা এইবারে করে ফেললে হয় না?”
সাধুবাবা রোষকষায়িত লোচনে তাকে ভেদ করে বলল, “দুর ব্যাটা পাষণ্ড, আমার দেহ ছাড়তে-ছাড়তে আরও সত্তর-পঁচাত্তর বছর। তাও ক’টা বছর পর্বতগুহায় ধ্যানাসনে কাটিয়ে দিতে হবে।”
ভারী হতাশ হয়ে গদাই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “আহা, শুনে ধড়ে প্রাণ এল। সত্তর-পঁচাত্তর বছর লম্বা সময়।”