“জি হুজুর!”
“আমাকে কেমন দেখছিস?”
“চমৎকার মালিক।”
“কেমন ডাকাতি করি?”
“খুব ভাল হুজুর।”
“তোর কি মনে হয় আমি একদিন দেশের সবচেয়ে বড় ডাকাত হব?”
“আপনার চেয়ে বড় ডাকাত কেউ নেই মালিক!”
“কিন্তু একটু খিচ থেকে যাচ্ছে যে?”
“কীসের খিচ হুজুর? হুকুম করুন, সব ঠিক করে দেব।”
“এক বালতি দুধে এক ফোঁটা চোনা পড়লে কী হয় জানিস?”
“দুধ কেটে যায়।”
“আমারও যে তাই হচ্ছে।”
“কেন হুজুর?”
“লোকে আমাকে খাতির করছে বটে, কিন্তু সেটা তোর জন্য।”
“আমি তো আপনার গোলাম আছি মালিক।”
“সেইটেই তো হয়েছে মুশকিল। আমার সন্দেহ হচ্ছে, লোকে আমাকে যতটা না ভয় পায়, তার চেয়ে তোকে ভয় পায় অনেক বেশি। এটা কি তাদের উচিত হচ্ছে?”
“না হুজুর। কী করতে হবে হুকুম করুন।”
“আমার মনে হচ্ছে, তুই সব সময় সঙ্গে-সঙ্গে থাকলে ওরা আমাকে ভয় পাবে না। তোর ভয়ে আমাকে মেনে নেবে। আমার তেমন নামও হবে না।”
“জরুর হবে মালিক। হুকুম করুন, সবাইকে সবক শিখিয়ে দেব।”
“ঠিক আছে। কিন্তু আমার মনটায় বড় খচখচ করছে রে। নামডাক হচ্ছে বটে, লোকে ভয়ও খাচ্ছে। কিন্তু কোথায় যেন এক চিমটি খামতিও থেকে যাচ্ছে।”
“হুঁজুর, পায়েসপুরের লোকেরা কিন্তু আপনার জন্য তৈরি হয়ে আছে।”
“তার মানে?”
“তাদের হাতে লাঠি, সড়কি, দা এবং বঁটি তো আছেই, দু’জনের হাতে দোনলা বন্দুকও আছে। তারা আপনাকে ‘কুটুম’ সম্বোধন করে নানারকম গালিগালাজও করছে। তারা নাকি আজ রক্তগঙ্গা বইয়ে দেবে?”
“বাঃ বাঃ! এই তো চাই। পায়েসপুরের লোকেরা তো বেশ বীর দেখছি! যেখানেই যাই সেখানেই লোকেরা সব ভয় খেয়ে তাড়াতাড়ি সোনাদানা, টাকাপয়সা বের করে দেয়, সেলাম ঠুকে পথ ছেড়ে দেয়, হাত কচলায়, ছ্যাঃ ছ্যাঃ! ডাকাতি করাটা যেন জলভাত হয়ে যাচ্ছে। এরকম হলে ডাকাতিতে সুখ কী? একটু লড়ালড়ি হবে, গুলিগোলা চলবে, খুনজখম হবে, লাশ পড়বে, তবে না সুখ!”
“হুঁজুর, যদি হুকুম দেন তো আগেভাগে গিয়ে ওদের অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে সব কটাকে বেঁধে রেখে আসি।”
“খবরদার না! তাতে আমার নামও হবে না, আনন্দও হবে। তুই ব্যাটা ডাকাতির বুঝিস কী? লড়ালড়ি না হলে যে শরীরটা গরমই হয় না বাপ! আর শরীর গরম না হলে আনন্দ কীসের? বরং পায়েসপুরের লোকদের আমার অভিনন্দন জানিয়ে দে। তারা যে বীরত্বের পরিচয় দিচ্ছে, তাতে আমি বেজায় খুশি।”
“তারা অভিনন্দন নিতে চাইছে না মালিক। তারা আপনার মুণ্ডু চাইছে।”
“বাঃ বাঃ, চমৎকার! ওদের জানিয়ে দে, যা চেয়েছ তার কিছু বেশি দেব, গুলির সঙ্গে মাথা!”
“গুলিগোলাকে তারা মোটেই ভয় পাচ্ছে না আঁহাপনা।”
“খুব ভাল, খুব ভাল। সব সময় কি রসগোল্লা খেতে ভাল লাগে রে! মাঝে-মাঝে একটু আখ চিবোতে বা কড়মড় করে ছোলাভাজা খেতেও তো ইচ্ছে যায়।”
“সে কথা ঠিক জনাব!”
পায়েসপুরে ঢুকবার মুখেই বিস্তর লোক সত্যিই পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে দেখতে পেয়ে গাব্বু একটা হুংকার ছাড়ল, “খবরদার! আমার পথ আটকালে তার পরিণাম কিন্তু ভয়ংকর! তোমরা সবাই হাত তুলে আত্মসমর্পণ করো।”
হারাধনবাবু উলটে চেঁচালেন, “কভি নেহি! বল বীর, চির উন্নত মম শির। বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী! পায়েসপুর জিন্দাবাদ।”
জনতাও সঙ্গে-সঙ্গে গর্জন করে উঠল।
তারপর বন্দুকের গুলির আওয়াজ, লাঠির ঠকাঠক, বল্লমের ঝলকের মধ্যে ধুন্ধুমার লড়াই হতে লাগল।
কিন্তু লড়াই খুব বেশিক্ষণ চলল না। পায়েসপুরের লোকেরা রণেভঙ্গ দিয়ে পালানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু দৈত্য তাদের ধরে এনে গায়ের চণ্ডীমণ্ডপে শামিল করল।
ঘোড়া থেকে নেমে হাসিমুখে গাবু বলল, “শাবাশ!” হারাধনবাবু জ্বলন্ত চোখে চেয়ে বললেন, “এক মাঘে শীত যায় রে গাব্বু!”
গাবু বলল, “দ্যাখো বাপু, বীরত্ব আমি পছন্দ করি বটে, কিন্তু আস্পর্দা আমার একদম সহ্য হয় না। বেয়াদপি করলে পায়েসপুরকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে যাব।”
নগেন সর্বাধিকারী ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “দোহাই বাবা, হারাধনের কথাটায় আমল দিয়ো না। পায়েসপুর আমাদের বড় আদরের গা তো, তাই ফস করে কথাটা বলে ফেলেছে। তা বাবা, তুমি নির্বিঘ্নে লুটপাট করে চলে যাও, কেউ কিছু বলবে না।”
গাঙ্কু একটু তেরছা হাসি হেসে বলল, “ছোঃ, লুটপাট! লুটপাট করার মতো তোমাদের আছেটা কী মশাই? থাকার মধ্যে ছিল তো এই পিদিমখানা। তা সেটাও কাজে লাগাতে পারনি! অপদার্থ আর কাকে বলে!”
ভিড়ের মধ্যে হলধর ঘোষ পিছন দিকটায় মাথাটা নুইয়ে পাশের গজপতিকে বললেন, “ইস! আমার হিপনোটিক রাইফেলটা যদি তৈরি থাকত, ব্যাটাকে মজা বুঝিয়ে দিতাম।”
অন্য পাশ থেকে ব্ৰজেন বোস খিঁচিয়ে উঠে বললেন, “তার চেয়ে একটা গাদাবন্দুক আবিষ্কার করলেও তো কাজের কাজ করতে। তোমার রোবট হাত-পা নাড়ল না, তোমার অটোমিস্ত্রি দেওয়ালে একটা পেরেকও পুতল না, অটোইস্তিরিকে দিয়ে ইস্তিরিটাও হল না, তা এতদিন ধরে করলেটা কী?”
হলধর কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন, গাবু একটা পেল্লায় ধমক দিয়ে বলল, “কে রে পিছনের সারিতে ফিসফাস করছিস? কোনও ষড়যন্ত্রের মতলব থাকলে কিন্তু মুশকিল আছে।”
হলধর উবু হয়ে তাড়াতাড়ি নিজের মুখে হাত চাপা দিলেন। গাব্বু উচ্চকণ্ঠে বলল, “শোনো হে পায়েসপুরের লোকেরা, পায়েসপুরের মতো একটা দীনদরিদ্র গ্রামে লুটপাট চালানো আমার উদ্দেশ্য নয়। দুচো মেরে আমি হাত গন্ধ করতে চাই না। মাতব্বরের মধ্যে কেউ একজন আমার এই আজ্ঞাবহের হাতে একটা টাকা দিয়ে বশ্যতা স্বীকার করে নিক, তা হলেই হবে।”