হলধর অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, “সে আপনারা বুঝবেন না।”
“আহা, আমাদের বুঝবার দরকারটাই বা কী? কথা হল, তুমি নিজে বুঝে উঠতে পেরেছ কিনা।”
হলধর গম্ভীর গলায় বললেন, “বোঝা যাবে মশাই, দু-চার দিনের মধ্যেই বোঝা যাবে। তারপর দেখবেন, দুনিয়ার তাবড় সায়েন্টিস্টরা লাট খেয়ে এসে এই পায়ের উপর পড়বে।”
খগেন তপাদার শঙ্কিত গলায় বলে উঠলেন, “উঁহু, উঁহু, ওটা মোটেই ঠিক হবে না। অত হোঁতকা, পেল্লায় চেহারার সাহেব এসে তোমার প্যাকাটির মতো পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে কুমড়ো গড়াগড়ি খেলে তোমার সুবিধে কী? দু’খানা তো মোটে পা, অত সাহেবের মধ্যে ভাগাভাগি হলে যে ভাগের পা গঙ্গাযাত্রা করবে হে!”
হলধর রোষকষায়িত লোচনে খগেনের দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে তাকে ভস্ম করার একটা চেষ্টা করে বললেন, “জানো, আমি একসময় ফাস্ট ডিভিশনের ফুটবল খেলোয়াড় ছিলাম! কোন সাহসে তুমি বললে যে, আমার পা পাকাটির মতো?”
ব্ৰজেন বোস তাড়াতাড়ি মাঝখানে পড়ে বললেন, “আহা, যেতে দাও ভায়া, যেতে দাও! একথা কে না জানে যে, খগেনের চোখে ছানি পড়েছে। আর এও সবাই জানে যে, তুমি একসময় দুর্দান্ত ফুটবল খেলতে। বিজ্ঞানের পায়ে সেই ফুটবলকে উৎসর্গ করেছ বই তো নয়। একসময় ফুটবল নিয়ে তুমি যেমন ছিনিমিনি খেলতে আর অপোনেন্টকে ধোকা দিয়ে বোকা বানাতে, আজও তেমনই বিজ্ঞানকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলছ আর পাঁচজনকে ধোকা দিয়ে বোকা বানিয়ে চলেছ।”
কথাটা শুনে হলধর প্রথমটায় খুশি হয়ে মাথা নাড়ছিলেন, কিন্তু অন্য সকলের খুকখুক হাসির শব্দ পেয়ে গম্ভীর হয়ে বললেন, “ব্ৰজেন, কাল থেকে তোমার চা আর খগেনের চিড়েভাজা বন্ধ।”
ব্ৰজেন দুঃখিত হয়ে বললেন, “কলিকালের সবচেয়ে বড় লক্ষণ কী জানো? লোকে ভাল কথাকেও উলটো করে বোঝে।”
দাড়ি-গোঁফ এবং চিন্তায় সমাচ্ছন্ন হয়ে নগেন সর্বাধিকারী এতক্ষণ এক পাশে চুপ করে বসে ছিলেন। বলতে কী, তিনিই পায়েসপুরের সবচেয়ে বলিয়ে-কইয়ে আর হাসিখুশি লোক। কিন্তু কয়েকদিন হল তার মনটা বিশেষ ভাল নেই। কথা বন্ধ, কপালে চিন্তার ভাঁজ, চোখে অন্যমনস্কতা, মাঝে-মাঝে দীর্ঘশ্বাসও পড়ছে। “কী হয়েছে,” জিজ্ঞেস করলে একটু অবাক হয়ে বলছেন, “কই, কিছু হয়নি তো!” চাপাচাপি করেও লাভ হচ্ছে না।
গাঁয়ের কেউ বলছে, নগেনের ছোট নাতি পান্টু গত পরীক্ষায় ইংরেজিতে ফেল করেছে বলে তাঁর মনখারাপ। পাড়ার ক্লাবের সেক্রেটারি সুবলের ধারণা, শিন্ডের খেলায় মোহনবাগান হেরে যাওয়ায় নগেন ভেঙে পড়েছেন। হারু নস্করের আরও গোপন খবর হল, বাসুচোর নাকি সেদিন রাতে নগেনবাবুর বাড়িতে হানা দিয়ে তন্নতন্ন করে হাতড়েও বাইশ টাকা পঞ্চাশ পয়সার বেশি না
পেয়ে রেগে গিয়ে যাচ্ছেতাই ভাষায় কিপটে নগেনবাবুকে খুব অপমান করে যাওয়ায় তিনি গুম মেরে গিয়েছেন। লটারির এজেন্ট বিশ্বপতি দুঃখ করে বলেছে, “না না, ওসব নয়। তিন দুই পাঁচ সাত দুই এক নম্বর টিকিটে পাঁচ লাখ টাকা প্রাইজ পেয়ে কেতনপুর গাঁয়ের নবকুমার ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাসে চেপে সপরিবার কাশ্মীর বেড়াতে চলে গেল। আর নগেনবাবুর টিকিটের নম্বর হল তিন দুই পাঁচ সাত দুই শূন্য। তাই নগেনবাবু ভারী মনমরা হয়ে পড়েছেন।”
তার পাশের বাড়ির দ্বিজেন সামন্ত অবশ্য অন্য কথা বলে বেড়াচ্ছে, “কয়েকদিন আগে নাকি এক জটাজুটধারী পেল্লায় চেহারার সাধু এসে নগেনকে বলল, ‘তোর ভাগ্য খুলে গেল রে ব্যাটা। ছল্পর ফুড়ে তোর পয়সা আসছে। তার আগে এই সাধুকে একটু ভোজন করা তো ব্যাটা! এই শুনে নগেনবাবু রেগে গিয়ে সাধুকে বাংলা, ইংরিজি এবং হিন্দিতেও খুব গালাগালি করেন, ‘কেটে পড়ো, গেট আউট এবং ভাগো ইহাসে,’ বলে তাড়িয়ে দেন। সাধু তখন ঝোলা থেকে একটা পাথর বের করে বলল, ‘তুই কী জিনিস হারালি তা জানিস না! সারাজীবন বুক চাপড়ে, হা-হুঁতাশ করে মরবি। এই দ্যাখ,’ বলে সাধু পাথরটা ত্রিশূলে ঠেকাতেই নাকি ত্রিশূল সোনা হয়ে যায়। তাই দেখে নগেন মূর্ছা যান। মূর্ছা ভাঙার পর থেকেই তিনি নাকি ভেঙে পড়েছেন। বিস্তর খুঁজেও সাধুর টিকিটিও আর দেখা যায়নি।”
রটনাগুলো যে সব মিথ্যে এমন কথাও বলা যাবে না। নগেনবাবুর ঘোট নাতি পান্টু গত পরীক্ষায় বাস্তবিকই ইংরেজিতে এগারো পেয়েছে। এও সত্যি যে, শিন্ডের খেলায় মোহনবাগান হেরেছে। আর কদিন আগে যে একটা চোর নগেনবাবুর বাড়িতে হানা দিয়েছিল এবং পরদিন ভূপেনদাতোগা কী কী চুরি গিয়েছে তার তালিকা চাওয়ায় নগেনবাবু খুবই অপ্রতিভ মুখে আমতা আমতা করেছিলেন, এও সবাই জানে। নবকুমার যে লটারিতে পাঁচ লাখ জিতেছে এবং নগেনবাবুর ভাগ্যে যে অল্পের জন্য শিকে ছেড়েনি, এটাও কারও অবিদিত নয়। দিনপাঁচেক আগে এক দুপুরে যে পেল্লায় চেহারার এক সাধু নগেনের বাড়িতে হানা দিয়েছিল এটাও ঘটনা। তবে ঠিক কী কারণে নগেনবাবু গুম মেরে গিয়েছেন সেটা এখনও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।
চা আর চিড়েভাজা এসে গিয়েছে। কাজেই সকলেই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ঠিক এই সময় হঠাৎ মৌনী ভেঙে নগেন সর্বাধিকারী অস্ফুট গলায় কী যেন একটা বলে উঠলেন। চিড়েভাজার দরুন কথাটা ভাল বোঝা গেল না। খগেন তপাদার একটু ঝুঁকে পড়ে বললেন, “কী যেন বললেন নগেনদা? কাবলিওয়ালা না কী যেন!”