“ওরেব্বাস রে! ও কাজও কোরো না। কোনও মনিষ্যির সাধ্যিই নেই তার কিছু করে। হিতে বিপরীত হয়ে যাবে বাবা! পিদিম না পেলে সে যে গায়ে ঢুকে কী কুরুক্ষেত্র বাধাবে কে জানে।”
“পিদিম! পিদিম তো আমাদের কাছে নেই! চুরি হয়ে গিয়েছে।”
চোখ বড়-বড় করে গদাই বলল, “নেই! তা হলে তুমি দানুকে পেলে কোথায়? তার তত পিদিম থেকেই বেরনোর কথা!”
“তোমার মাথা! দানু মোটেই পিদিম থেকে বেরোয়নি।”
“তা হলে!”
“আচ্ছা, তোমার কি ঘটে কোনও বুদ্ধি নেই? চিরকাল বুজরুকি গল্পে বিশ্বাস করে যাবে? পিদিমের মধ্যে কি কোনও মানুষ লুকিয়ে থাকতে পারে?”
“আহা, মানুষ পারবে কেন? তবে দত্যিদানোরা যে সূক্ষ্মদেহ ধারণ করতে পারে?”
“দত্যিদানো বলেও কিছু নেই। ওসব মানুষের অলস কল্পনা। সূক্ষ্ম দেহটেহ সব বাজে কথা। এখন কেটে পড়ো!”
গদাই উঠতে-উঠতে বিড়বিড় করে বলল, “ভাল কথাটা শুনলে বাবা, ঠেলা বুঝবে!”
ঠেলা টের পেতে দেরি হল না পান্টুর। গদাই পায়েসপুরের ঘরে-ঘরে খবরটা ছড়িয়ে দিয়ে সবাইকে হুশিয়ার করে দিয়ে গেল। আর খবরটা খেয়েও গেল সবাই। নগেনবাবুর বাবার আমলের পিদিমের কথা কানাঘুষোয় সবাই শুনে গিয়েছিল। দানুর কীর্তিকাহিনির কথাও সবাই জানে। এবং সাধুর আগমন নিয়ে তো কোনও সন্দেহের অবকাশই নেই। সেই সঙ্গে প্রদীপের দৈত্য দানুর জন্যই যে আজ পায়েসপুরের দুঃসময় এসেছে, সে বিষয়েও কারও আর সংশয় রইল না।
সন্ধেবেলায় চণ্ডীমণ্ডপে জরুরি মিটিং ডাকা হল। সেই মিটিঙে সর্বসমক্ষে নগেন সর্বাধিকারী সাধুর দেওয়া পিদিমটার কথা স্বীকার করলেন। তবে এও বললেন, “পিদিমের মহিমার কথা আমি জানি না। আমার বাবা হয়তো জানতেন, কিন্তু আমাদের পিদিম নিয়ে নাড়াচাড়া করায় বারণ ছিল।”
জয়লাল বলল, “আঃ হাঃ, বিরাট দাওটা ফসকেছেন দাদা! এতদিনে তো আপনার টাটা-বিড়লা হয়ে যাওয়ার কথা!”
হারাধন বললেন, “আগে জানলে তো পায়েসপুরকে একেবারে অলকাপুরী বানিয়ে ছাড়তাম মশাই। আগে বলতে হয়। এসব খবর চেপে রাখাটা ভুল হয়েছে।”
তারক সভয়ে বলল, “যাকগে, ওসব ভেবে আর লাভ নেই। পিদিমের মেয়াদ শেষ হয়েছে, যার পিদিম সে ফেরত নিতে এসেছে এবং পায়েসপুরের সামনে এখন ঘোর বিপদ। সুতরাং পান্টুকে ডাকা হোক। পিদিম তার কাছেই আছে এবং দানুই যে পিদিমের দৈত্য, সে বিষয়েও আর সন্দেহের অবকাশ থাকছে না।”
এ কথায় সবাই একমত হল। কিন্তু পান্টু এসে সবার সামনে বলল, “আমি পিদিম কখনও চোখেও দেখিনি। দানু মোটেই দৈত্যদানো নয়।”
দ্বিজেন সামন্ত চেঁচিয়ে উঠে বলল, “দানু দৈত্য নয় বললেই হবে? দৈত্য না হলে কেউ দু’দিনে চল্লিশ-পঞ্চাশটা গাছের নারকোল পেড়ে ফেলতে পারে? এত বড় পুকুরটার কচুরিপানা একদিনে তুলে ফেলতে পারে? নাকি হবিবপুরের মতো শক্ত টিমকে পাঁচ-পাঁচখানা গোল দিতে পারে?”
সবাই হইচই করে দ্বিজেনকে সমর্থন জানাল। দু-চারজন পান্টুর পক্ষ নেওয়ার চেষ্টা করল বটে, কিন্তু তারা নিতান্তই সংখ্যালঘু।
সকলের সমবেত বাক্যবাণে এবং উগ্রতা দেখে পান্টু যখন কোণঠাসা, তখনই হঠাৎ অন্ধকার কুঁড়ে দানু চণ্ডীমণ্ডপে উঠে এসে বলল, “ওকে ওরকম হেনস্থা করছেন কেন? যা বলার আমাকে বলুন।”
প্রথমটায় হকচকিয়ে গেলেও পরক্ষণেই রে রে করে তেড়ে গিয়ে সবাই দানুকে পেড়ে ফেলল। দানু তেমন বাধাও দিল না।
দ্বিজেন সামন্ত বলল, “ভাল করে দড়ি দিয়ে বাঁধো, যাতে পালাতে না পারে। কাল সকালেই ওকে সাধুর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। যদিও প্রদীপের দৈত্যকে দিয়ে অনেক ভাল কাজও হতে পারত, কিন্তু আমরা আর কোনও ঝুঁকি নিতে পারি না। কী বলো ভাইসব?”
সকলেই হইহই করে উঠল, “ঠিক ঠিক!”
৫. একদিন সকালবেলায় গাব্বু
একদিন সকালবেলায় গাব্বু তার চুরি করা জিনিসপত্তরগুলো বের করে মেঝেয় ছড়িয়ে বসে দেখছিল। তেমন সুবিধে করে উঠতে পারছে না সে। তার হাত এখনও পাকেনি, ওস্তাদের অনেক গুণই সে অর্জন করতে পারেনি। চুরির জিনিসগুলো নিতান্তই এলেবেলে। রুপোর সিঁদুরের কৌটো, সস্তার দু’টো হাতঘড়ি, একটা টর্চবাতি, কয়েকটা স্টিলের বাটি, গোটা দুই শাড়ি, একজোড়া সোনার মাকড়ি, পেতলের ঘটি, একখানা পেতলের পিদিম, একটা পেতলের মোমদানি, একশিশি চ্যবনপ্রাশ, বেচলে কুড়িয়ে বাড়িয়ে শ’দুয়েক টাকা হতে পারে। মহাজন তাও দেবে কিনা সন্দেহ। ইদানীং চোরাই জিনিস কিনতে চাইছে না। সোনার মাকড়ি দুটোই যা বিকোবে। তবে খুবই হালকা জিনিস।
গাব্দু একটু উদাস চোখে জিনিসগুলো দেখতে-দেখতে তার নিজের অপদার্থতার কথা ভাবছিল। সে বংশানুক্রমেই চোর। তার ঠাকুরদা চোর ছিল, বাবা চোর ছিল এবং তাদের বেশ নামডাকও হয়েছিল। কিন্তু গাব্বু নিতান্তই কুলাঙ্গার। এই সব ভাবতে-ভাবতে সে জিনিসগুলো একটু নেড়েচেড়ে দেখতে হঠাৎ পিদিমখানা হাত ফসকে পড়ে যেতেই ঠাৎ করে শব্দের সঙ্গে-সঙ্গে একটা বিদ্যুতের মতো ঝলকানি। বোমা মনে করে গান্ধু আঁতকে উঠে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল। চোখ খুলে সে কাঠ। সামনে একটা পেল্লায় চেহারার দানব দাঁড়িয়ে আছে, মাথা ঠেকেছে ঘরের চালে। গায়ে জরির পোশাক ঝলমল করছে। হাতজোড় করে ভারী বিনয়ের সঙ্গে বলল, “হুঁকুম করুন হুজুর!”
ব্যাপারটা একদম বুঝতে না পেরে গাব্বু হাঁ করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ভয়ে কাঁপতে-কাঁপতে বলল, “আপনি কে?”