দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর মলিন মুখ করে জানালার পাশে চেয়ারে বসে ঘটনার বিশ্লেষণ করতে-করতে পান্টু মাথা নেড়ে অস্ফুট গলায় বলে ফেলল, “নাঃ, দানুকে চাই।”
প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই জানালার বাইরে দানুর গলা শোনা গেল, “আমাকে খুঁজছ?”
স্তম্ভিত প্রাণারাম কিছুক্ষণ হাঁ করে অবিশ্বাসের চোখে চেয়ে থেকে বলল, “তুই! তুই কোথায় ছিলি হতভাগা? তোর নামে যে হুলিয়া বেরিয়েছে?”
“কেন?”
“সবাই বলছে তুই নাকি পিসিমার গয়না চুরি করে পালিয়েছিস?”
“গয়না চুরি যাবে কেন?”
“তা হলে গয়নাগুলো গেল কোথায়?” গলার ঘামাচি চুলকোচ্ছিল বলে পিসিমা নিজেই হারটা খুলে ঘুমচোখে বালিশের নীচে রেখেছিলেন। রাখতে গিয়ে সেটা ওয়াড়ের মধ্যে ঢুকে যায়। সেখানেই আছে।”
“আর বালা?”
“পিসিমার বড্ড ভুলো মন। কাল পোস্ত বাটতে গিয়ে বালা খুলে তেজপাতার কৌটোর পিছনে রেখেছিলেন, তারপর ভুলে গিয়েছেন।”
“তা হলে তুই পালালি কেন?”
“না পালিয়ে উপায় নেই। আমাকে একজন ধরতে এসেছে!”
“তোকে ধরতে এসেছে? তোকে ধরবে কেন?”
“সব কথা বলা যাবে না। আমার খুব বিপদ। তবে খুব যদি দরকার হয় তা হলে আমাকে ডেকো, ডাকলেই আসব।”
“আমার ডাক তুই শুনতে পাবি কী করে?”
দানু বড়-বড় দাঁত দেখিয়ে হেসে বলল, “তোমার ডাক আমি ঠিক শুনতে পাই। তবে এ কথাটা কাউকে বোলো না।”
“তোর কীসের বিপদ আমাকে বলবি না? আমরা তো তোর বিপদে সাহায্য করতে পারি!”
“পরে তোমাকে সব বলব। এখন যাই?”
“যা!”
দানু চোখের পলকে হাওয়া হয়ে গেল। কিন্তু তার কথামতো বালিশের ওয়াড়ের ভিতরে আর তেজপাতার কৌটোর পিছনে সরযূদেবীর হারানো গয়না পাওয়া গেল। ফের পায়েসপুরের মাতব্বররা জড়ো হয়ে এই ব্যাপারটা নিয়ে তুমুল আলোচনা করলেন।
ভূপেনদারোগাকে যখন ঘটনাটা জানানো হল, তখন উনি ভ্রু তুলে বললেন, “তাই নাকি? তা হলে কী সাব্যস্ত হল?”
হারাধনবাবু এগিয়ে এসে বুক চিতিয়ে বললেন, “তাতে এই সাব্যস্ত হল যে, দানু মোটেই চুরি করেনি এবং নেক্সট ম্যাচে হবিবপুরের বিরুদ্ধে খেলবে।”
ভূপেনবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “না, খেলবে না।”
“কেন খেলবে না বলুন?”
“তার বিরুদ্ধে আরও একটি গুরুতর অভিযোগ আছে। ম্যাচের দিন সে হবিবপুরের লোকজনের উপর হামলা করেছিল। তার সেই হামলায় কয়েকজন গুরুতর আহতও হয়। হবিবপুরের শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের উপর বিনা প্ররোচনায় এই আক্রমণ অত্যন্ত নিন্দনীয়।”
হারাধনবাবু এবং কালীপদবাবু একযোগে বলে উঠলেন, “না স্যার, সেদিন হবিবপুরের গুন্ডারাই ম্যাচ হেরে গিয়ে আমাদের উপর চড়াও হয়। আমরা থানায় নালিশও জানিয়েছি।”
“আপনাদের পাঁচ মিনিট আগে হবিবপুর এফ আই আর করেছে। সুতরাং তাদের কে অনেক জোরালো।”
সবাই কাঁচুমাচু হয়ে পাংশু মুখে ফিরে এলেন। এবং সবাই একবাক্যে স্বীকার করলেন যে, এই রকম অন্যায়ভাবে হবিবপুরের কাছে হেনস্থা হওয়াটা দুর্ভাগ্যজনক। হারাধনবাবু অত্যন্ত ব্যথিত মুখে বলতে লাগলেন, “না হে, এখন আমাদের পায়েসপুরের বড় দুঃসময় চলছে।”
পরশুদিন সন্ধের সময় যখন এই ঘটনা নিয়ে চণ্ডীমণ্ডপে মিটিং চলছিল, তখনই খবর আসে যে, বটেশ্বরকে এক নরখাদক সাধু ধরে নিয়ে গিয়েছে। এবং সেটা নিয়ে তোলপাড় শেষ হতে না-হতেই রাধাগোবিন্দর নিরুদ্দেশ হওয়ার খবরে পায়েসপুর একেবারে শোকে স্তব্ধ হয়ে গেল।
ভূপেনদারোগা তদন্তে এলেন বটে, কিন্তু কেমন যেন গা ছাড়া ভাব। বটেশ্বরের খবর শুনে নাক কুঁচকে বললেন, “পায়েসপুরে কেমন পালোয়ান তৈরি করেন আপনারা বলুন তো? নেংটি পরা একটা সাধু এসে একটা তাগড়াই লোককে তুলে নিয়ে গেলেই হল? তেমন পালোয়ন থাকা না-থাকা সমান। ওরকম অপদার্থকে যদি সাধু কেটেকুটে রান্না করে খেয়ে ফেলেই থাকে, তা হলে একরকম ভালই হয়েছে। আর রাধাগোবিন্দবাবু! হাঃ হাঃ। তিনি নাকি ডাকসাইটে দারোগা ছিলেন! হেসে বাঁচি না। যখন যেখানে বদলি হয়ে যেতেন, সেখানেই চোর-ডাকাতদের মধ্যে আনন্দের সাড়া পড়ে যেত। একবার তো কালিকাপুরের ডাকাতরা তাকে গণসংবর্ধনাও দিয়েছিল। আর দেবে না-ই বা কেন? সকালে একপেট ভাত খেয়ে সেই যে থানার চেয়ারে বসে ঘুমিয়ে পড়তেন, সেই ঘুম ভাঙত বিকেল পাঁচটায়, তার বাড়ি যাওয়ার সময়। তার মতো লোক বটেশ্বরকে উদ্ধার করতে গিয়ে লোপাট হয়েছেন, এও কি বিশ্বাস করতে বলেন? তিনি আবার ‘দারোগার দীর্ঘশ্বাস নামে বই লিখছেন। হুঃ! দারোগাগিরির উনি জানেনটা কী?”
কেপুবাবু আমতা-আমতা করে বললেন, “কিন্তু নিকুঞ্জ বৈরাগী যে বলেছিল, রাধাগোবিন্দবাবু রেগে গেলে খ্যাপা ষাঁড়!”
“ষাঁড় কথাটা খারাপ নয়। ‘অকালঘেঁড়ে’ বলে কী একটা কথাও যেন আছে। রাধাগোবিন্দবাবু হচ্ছেন তাই। তবে আপনারা যাই বলুন, ওই সাধুর গল্পটি আমি বিশ্বাস করছি না। ওটা আষাঢ়ে গল্প। আমার সেপাইরা সারা জঙ্গল তছনছ করে খুঁজে এসেছে, কোথাও কোনও সাধুর চিহ্নমাত্র দেখেনি।”
জয়লাল বলল, “তা হলে ওরা গেল কোথায়?”
“আত্মীয়স্বজন বা কুটুমদের বাড়ি খুঁজে দেখুন। বাড়িতে ঝগড়া করে বৈরাগী হয়েছে কিনা খোঁজ নিন। তবে লাশটাশ পাওয়া গেলে খবর দেবেন, তখন এসে দেখব। এখন আমার সময় নেই। চারদিকে খুব চুরি-ডাকাতির খবর পাচ্ছি। কিছু খুনখারাপিও হচ্ছে। আমাকে তদন্তে যেতে হবে।”