ভীমরতি আর কাকে বলে? পরদিন আলায়বালায় ঘুরে গদাই দিনান্তে আস্তানায় ফিরে দ্যাখে, সাধুজি যথারীতি সিদ্ধি ঘুটতে লেগেছে। কিন্তু চাতালের উপর আজ আগের দানোটার পাশে আরও একটা লোক পড়ে আছে। এটারও হাত-পা সব লতাপাতায় আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা।
গদাই অবাক হয়ে বলল, “উটি আবার কে বাবা?”
সাধু গম্ভীর হয়ে বলল, “এটাও দানো!”
গদাই ভারী ভাবিত হয়ে বলল, “কোথাও গোলমাল হচ্ছে না তো বাবা? একটা পিদিমের মধ্যে কি দু-দু’টো দত্যি সেঁধিয়ে ছিল? কিন্তু তেমনটা তো শুনেছি বলে মনে হয় না।”
সাধুও একটু দোনামোনা করে বলল, “সেটাও একটা কথা। পিদিমে একটা দৈত্যই ছিল বটে!”
গদাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “নাঃ, আপনাকে এবার ভীমরতিতেই ধরেছে দেখছি বাবা! তা ইটিকে পেলেন কোথায়?”
সাধু গলায় সিদ্ধি ঢেলে বিরাট দূগা তুলে বলল, “দুপুরের দিকে একটু গড়াচ্ছিলুম। হঠাৎ দেখি, দানোটা গাছপালা ভেঙে পাগলা হাতির মতো ধেয়ে এসে আমার চুল-দাড়ি ধরে টানাটানি। কিল ঘুসোও দিচ্ছিল। মনে হল, এটাই আসল দানোর পিদিমের মালিক হয়তো আমাকে ঢিট করতে পাঠিয়েছে। কিন্তু আমাকে ঢিট করা কি সোজা! ওই দ্যাখ, মায়ালতায় বেঁধে ফেলে রেখেছি। কিন্তু মুশিকল কী জানিস, কোনটা আসল দানো তা বুঝে উঠতে পারছি। না। বড্ড বুড়ো হয়ে গিয়েছি তো! আজকাল একটুআধটু ভুলভাল হয়।”
“কিন্তু বাবা, এদের তো মানুষেরই আকার দেখছি। একটু লম্বাই চওড়াই চেহারা বই তো নয়! ধরুন যদি দানো না হয়ে মানুষই হয়, তা হলে যে এভাবে ফেলে রাখলে খিদে-তেষ্টায় মরে যাবে। তখন যে মহাপাতক!”
সাধু ঘনঘন মাথা নেড়ে বলল, “সে ভয় নেই। বিশল্যকরণীর সঙ্গে সঞ্জীবনী আরক আর সিদ্ধি খুঁটে খাইয়ে দিয়েছি। মরার উপায় নেই। কিন্তু পিদিম উদ্ধার না হলে দানো নিয়ে গণ্ডগোল পাকিয়ে উঠবে। তুই কালই গাঁয়ে গিয়ে যত লম্বা-চওড়া লোক আছে সব ক’টাকে ভাল করে চিনে আসিস তো?”
গদাই সভয়ে বলল, “মহারাজ, এই পায়েসপুর গায়ে লম্বা চওড়া নোক যে মেলা। সব কটাকে আনলে যে গায়ে হুলস্থুল পড়ে যাবে?”
সাধু চিন্তিত মুখে বলল, “তা বটে। কিন্তু পিদিমটা উদ্ধার না হলে যে এ ছাড়া উপায় নেই? একটা পরিবার নির্বংশ হবে। কোন বদমাশের হাতে পড়ে পিদিম কী কাণ্ড ঘটাবে তা কে জানে?”
“তা আপনি তো ত্রিকালদর্শী, এত সাধন-ভজন করেছেন, ধ্যানের চোখে পিদিমটার হদিশ দিতে পারেন না?”
সাধু দুঃখের সঙ্গে মাথা নেড়ে বলল, “ঊর্ধ্বনেত্র আর সুরত চড়াই হওয়ার পর থেকে আর হঠযোগের ক্ষমতা থাকে না। আমি তো আর সিদ্ধাই নই, আমার ধ্যানে ওসব ছোটখাটো জিনিস আসে না। তবে পিদিম যে পায়েসপুরেই আছে তা টের পাচ্ছি।”
“হুঁকুম দেন তো, আপনার শ্রীচরণের আশীর্বাদে আমি একটু সুলুকসন্ধান করে দেখি।”
“তোর চোখে এখনও লোভ চকচক করছে যে?”
গদাই হাত জোড় করে বলল, “তা পাপীতাপী মানুষ বাবা, লোভলালসা নিয়েই তো বেঁচে থাকা। তবে লোভ থাকে থাক, সঙ্গে তো আপনার ‘উঁহু’-ও আছে বাবা!”
৪. একদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে
একদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই সরযূদেবী দেখলেন, তাঁর গলায় সাত ভরি ওজনের মটরদানা হারটা নেই। নেই তো নেই-ই। সারাবাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও সেটা পাওয়া গেল না। সরযূদেবীর তো মাথায় হাত। ঠিকেকাজের লোক সাবি কাজ করতে এসে হঠাৎ হাউমাউ করে বলে উঠল, “ও মা! তোমার হাতের বালাজোড়া কোথায়? সেও কি চোরের বাপের শ্রাদ্ধে গেল?”
সরযূদেবী চমকে উঠে অবাক হয়ে খেয়াল করলেন, সত্যিই তো? বালাজোড়াও তো নেই। তিনি কুঁকড়ে কেঁদে উঠে বললেন, “ওরে, দানুকে শিগগির ডাক। দানুই তো রাতে পাহারা দেয়!”
কিন্তু দানুকে কোথাও পাওয়া গেল না। নীচের বারান্দায় তার চটের বিছানা একপাশে পরিপাটি গুছিয়ে রাখা। সে কোথাও নেই। নেই তো নেই-ই। একেবারে ভো ভা।
সুতরাং দুইয়ে-দুইয়ে চার করতে কারও দেরি হল না। খবর পেয়ে গায়ের লোক ভেঙে পড়ল সরযূদেবীর বাড়িতে।
জয়লাল বলল,”আমি আগেই জানতাম এরকম হবেই।”
তারক তর্কালঙ্কার খিঁচিয়ে উঠে বলল, “কী জানতে শুনি?”
“ওহে, কোনও জিনিসেরই বাড়াবাড়ি ভাল নয়। বেশি করিতকর্মা লোক দেখলেই বুঝতে পারি মতলব খারাপ। এই যে দানু দু’ দিনে তিরিশ-চল্লিশটা গাছের নারকোল পাড়ল, একদিনে অত বড় পুকুরের পানা পরিষ্কার করল, ফুটবল খেলতে নেমে গন্ডায়-গন্ডায় গোল করল, এসব কি ভাল? এ হল কোপ দেওয়ার আগে ঘাড়ে তেল মালিশ করা।”
তারক বলল, “ওহে, বিজ্ঞান প্রমাণ ছাড়া কোনও সত্যকে গ্রহণ করে না। অপরাধবিজ্ঞানও কিন্তু একটা বিজ্ঞান। প্রমাণ কই?”
হারানবাবু এসে উত্তেজিতভাবে বললেন, “আমার বাড়িতেও কাল চোর ঢুকেছিল।”
খগেন তপাদার বললেন, “কী করে বুঝলেন?”
“আমার পাঁচ ব্যাটারির টর্চটা আমার বালিশের পাশেই থাকে। সকালে উঠে দেখি সেটা চুরি হয়ে গিয়েছে। তারপর ধরো, চ্যবনপ্রাশের কৌটোটা গায়েব, অ্যালার্মক্লকটা হাওয়া, একখানা গেঞ্জি পাওয়া যাচ্ছে না…”
হারানবাবুর মেয়ে খেদি পাশ থেকে বলল, “ও বাবা, টর্চটা তো কাল জামাইবাবুকে দিলে? চ্যবনপ্রাশের কৌটো খালি হয়ে গিয়েছে বলে মা তাতে পাঁচফোড়ন রেখেছে। অ্যালার্মক্লকটা তো সারাতে দেওয়া হয়েছে, আর গেঞ্জি আজ সকালে কেচে দেওয়া হয়েছে।”