সাধুর ভয়ে ঝোলাটার দিকে কয়েকদিন আর নজর দেয়নি গদাই। তা একদিন সাধু ঝোলা রেখে চান করতে মন্দিরের পিছনে পুকুরে গিয়েছে, তখন অনেক চেষ্টাতেও নিজেকে সামলাতে পারল না গদাই। ঝটিতি গিয়ে ঝোলার মুখটা ফাঁক করেছে কি করেনি, অমনই ঝোলার ভিতর থেকে সেই বজ্রনির্ঘোষটা বেরিয়ে এল, “উঁহু!”
আঁতকে উঠে লম্ফ দিয়ে সরে এল গদাই। ই কী রে বাবা! ঝোলার ভিতর থেকে কে কথা কয়? ভূত নাকি রে ভাই?
সাধু স্নান সেরে এসে তার দিকে রক্তচক্ষুতে চেয়ে বলল, “ফের ঝোলায় হাত দিয়েছিলি নিমকহারাম?”
“তখন কি জানতাম যে আপনি না থাকলেও আপনার ওই বিটকেল ‘উঁহু’টাকে পাহারায় রেখে যাবেন! ঘাট হয়েছে বাবা, আর নয়!”
“মনে থাকে যেন!”
একদিন রাতে সাধুর পা দাবাতে-দাবাতে গদাই জিজ্ঞেস করল, “তা বাবা, পায়েসপুরে ফিরে আসতে আপনার পঁচাত্তর বছর লাগল কেন? পঁচাত্তর বছর যে বড্ড লম্বা সময়।”
সাধু গম্ভীর গলায় বলল, “সে তোদের কাছে। আমার তো শুধু পায়েসপুর নিয়ে কাজকারবার নয়। সারা দুনিয়াময় চক্কর কাটতে হয়। সাধন-ভজন আছে। তীর্থদর্শন আছে। পরিক্রমা আছে। ওসব তুই বুঝবি না। তবে এবার সব গুটিয়ে ফেলতে হবে। আয়ু আর বেশি দিন নয়। জিনিসপত্র সবই প্রায় উদ্ধার করে ফেলেছি। পিদিমখানা উদ্ধার হলেই কাজ একরকম শেষ।”
“তা সে পিদিমখানায় কী আছে বাবা?”
“ওঃ, সে বড় সাংঘাতিক জিনিস। অপাত্রে পড়লে দুনিয়া ছারখার হয়ে যাবে।”
“তা সেই সাংঘাতিক জিনিসটা হাতছাড়া করলেন কেন ঠাকুর?”
“সব জিনিসেরই ভালও আছে, মন্দও আছে। পিদিমখানা যাকে দিয়ে গিয়েছিলুম, সে দুঃখী মানুষ হলেও ভাল লোক। কিন্তু তার অবর্তমানে বেওয়ারিশ জিনিসটা কার হাতে পড়বে তার ঠিক কী?”
জিনিস ফিরি করে একদিন দিনান্তে আস্তানায় ফিরে মশালের আলোয় গদাই দেখতে পেল, একটা বেশ পেল্লায় চেহারার ছোঁকরাকে লতাপাতা দিয়ে চাতালে ফেলে রেখে সাধু গম্ভীর মুখে বসে সিদ্ধি গুলছে। মশালের আবছা আলোতেও ছোঁকরাকে চেনা-চেনা ঠেকল গদাইয়ের।
সে অবাক হয়ে বলল, “এ কাকে ধরে এনেছেন বাবা?”
সাধু থমথমে মুখে বলল, “এটাই সেই দানো। পিদিমের মধ্যে সেঁধিয়ে থাকার কথা। কোন অপাত্রের হাতে পড়ে ছাড়া পেয়ে মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। দেখতে পেয়ে ধরে এনেছি। ওর অসাধ্য তো কিছু নেই। তাই লতাপাতা দিয়ে বেঁধে রেখেছি। গভীর রাতে বিশেষ প্রক্রিয়ায় মন্তর দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেব। ঘুমোক ব্যাটা কয়েক হাজার বছর।”
“সেটা কি আলাদিনের সেই পিদিম নাকি বাবা? উরেব্বাস রে? সেই পিদিম যে পাবে সে তো রাজা!”
সিদ্ধি ঘুটতে-ঘুটতে সাধু গম্ভীর হয়ে বলল, “পাপীরা তাই ভাবে বটে! সুখ-সম্ভোগের জন্য হেঁদিয়ে মরছিস মায়াবদ্ধ জীব। পরমার্থ খুঁজলি না!”
“যে আজ্ঞে, সেও বড় জব্বর জিনিস। তবে কিনা আগে একটু সুখসম্ভোগ করে নিলে পরমার্থটা জমে ভাল। সোয়াদটা বেশি পাওয়া যায়। এই যেমন নিম-বেগুন বা উচ্ছে হলে পরে পঞ্চব্যঞ্জনের সোয়াদটা বেশ খোলে তো বাবা? দত্যিটাকে যদি ঘুম পাড়িয়ে রাখেন তা হলে পিদিমটা যে ফেকলু হয়ে যাবে?”
“তা তো বটেই।”
“সেটা কি ভাল হবে বাবা? বরং দত্যিটাকে একটু ছেড়ে দিন, ঘুমনোর আগে কয়েকটা কাজ করিয়ে নিই।”
“কী কাজ?”
“কুপিত হবেন না বাবা, বেশি কিছু নয়। এই গা-হাত-পা একটু টিপে দিল, মাথা মালিশ করল, ছোটমতো একটা বাড়ি করে দিল, একটু চাল-ডাল-নুন-তেল আর কিছু টাকাপয়সা জোগাড় করে নিয়ে এল, দু’-পাঁচখানা মোহর…”
সাধু হুংকার দিয়ে বলল, “পাপিষ্ঠ, নরাধম, ইষ্ট নষ্ট করতে চাস রে আহাম্মক? খাল কেটে কুমির আনবি বেল্লিক? মায়ালতায় বেঁধে রেখেছি বলে, নইলে এই রাক্ষস এতক্ষণে চারদিক লণ্ডভণ্ড করে দিত, তা জানিস?”
গদাই ভয় খেয়ে বলল, “ওরে বাপ রে! তা হলে বাঁধন খুলে দরকার নেই বাবা! যেমন বাঁধা আছে তেমনই বরং থাক। কিন্তু প্রভু, দানোটা অনেকক্ষণ ধরে চিচি করে কী যেন বলার চেষ্টা করছে, ভাল বোঝা যাচ্ছে না।”
ঘটি তুলে খানিক সিদ্ধি ঢকঢক করে খেয়ে সাধু একটা উদগার তুলে রক্তচক্ষুতে চেয়ে বলল, “বলছে নাকি?”
“বলছে বাবা।”
সাধু মাথা নেড়ে বলল, “কানে আজকাল ভাল শুনতে পাই না। ভোঁ ভোঁ শব্দ হয়। ইন্দ্রিয়াদির ক্ষমতা ক্রমে কমে আসছে। এবার কাজকারবার সব গুটিয়ে ফেলতে হবে রে।”
“সেই কথাই ভাল বাবা। পাথরটাথর, পিদিমটিদিম যা আছে তা ভক্তদের বিলি করে দিয়ে আপনি বরং নিশ্চিন্তে শেষ জীবনটা সাধন-ভজন নিয়ে থাকুন। আমি বরং এদিকটা সামাল দেব।”
“কোন দিকটা?”
“এই টাকাপয়সা, সোনাদানা, পাপতাপ এই সব আরকী।”
“তোর চোখে লোভ জ্বলজ্বল করছে। সেবার ঘুঘুডাঙার একটা দুঃখী লোককে দেখে বড় দয়া হয়েছিল। তাকে একখানা অক্ষয় থালা দিয়ে বলেছিলুম, ‘বাপু, এই থালা সামনে রেখে যা খেতে চাইবে তাই পেয়ে যাবে। কিন্তু ‘রয়েসয়ে খেয়ো’ তা ব্যাটা এমন খাওয়া খেল যে, দম নিতে পারে না। শেষে ওই দম আটকেই প্রাণপাখি বেরিয়ে গেল। ভেবে দেখিস, তুই কিছু খারাপ নেই। গায়ে হাওয়া লাগিয়ে এই যে পাঁচটা জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছিস, কষ্টের রোজগারে দু’টো খাচ্ছিস, এর চেয়ে ভাল আর কী হতে পারে? ফাঁকতালে ভোগ করার ফিকির যদি খুঁজিস তবে টসকে যাবি!”
মাথা চুলকে গদাই বলল, “আজ্ঞে, ভাল-ভাল কথাগুলো যখন শুনি বাবা, তখন পাপী মনটার জন্য ভারী লজ্জা হয়। কিন্তু মাঝে মাঝেই লোভটাও বড্ড ফোঁস করে ওঠে। এই যে কথাগুলো শুনলুম, ইচ্ছে হচ্ছে এখন থেকে ব্যোমভোলা ভাল লোক হয়ে যাই। মনটার মধ্যে বেশ একটা আঁকুপাঁকু হচ্ছে কিন্তু। যেন কাদায় পড়া মোষ কাদা ঠেলে উঠে আসতে চাইছে। তা আপনি যদি টেনে তোলেন তা হলে পাপ-পঙ্ক ছেড়ে পাপী মন একদিন গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়বে’খন।”