“আজ্ঞে, এটা লোহার বালা। এক ফকির দিয়েছিল।”
“দে ব্যাটা, ওটা খুলে দে।” সাধু তার ঝোলা থেকে একখানা পাথর বের করে বালায় ঠেকাতেই সেটায় যেন দপ করে আগুন ধরে গেল। প্রথমটায় আগুন বলেই ভ্রম হয়েছিল বটে গদাইয়ের। ভাল করে চোখ কচলে দেখল, আগুনটাগুন নয়, লোহার বালা এক লম্ফে ডবল প্রমোশন পেয়ে সোনা হয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ বাক্যি ছিল না মুখে, চোখের পাতাও পড়েনি তার।
সাধু তার হাতে বালাটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “যা ব্যাটা, এটা বেচে যা টাকা পাবি তাতে তোর অনটন খানিক ঘুচবে।”
গদাই ভেউ-ভেউ করে কেঁদে ফের কাটা কলাগাছের মতো পড়ে সাধুর পায়ে দণ্ডবৎ হয়ে বলল, “দিলেনই যদি বাবা, তবে মুঠিটা আরও একটু খুলুন। কেল্লার লোহার ফটকটা পড়ে আছে। ওটাতেও একটু ঠেকিয়ে দিন, তা হলে দুঃখু একেবারে ঘুচে যায়। দেড়-দু’ মন সোনা পেলে বাকি জীবনটা হেসেখেলে কাটিয়ে দেওয়া যাবে।”
সাধু দু পা পিছিয়ে গিয়ে হুংকার দিয়ে বলল, “বেশি লোভ করলে শূলে গেঁথে প্রাণবায়ু বের করে দেব হারামজাদা! কিছু দিলেই দেখছি তোদের লোভ বেড়ে যায়। দুর হয়ে যা আমার সুমুখ থেকে। বেশি লোভ করলে বিপরীত পাথর ঠেকিয়ে দেব, সোনা ফের লোহা হয়ে যাবে।”
গদাই ভয় পেয়ে উঠে বসল। চোখের জল মুছে একগাল হেসে বলল, “মারুন, কাটুন আর যাই করুন, আমি আপনার সঙ্গ ছাড়ছি না।”
তা সেই থেকে গদাই সাধুর সঙ্গে-সঙ্গে আছে। পুরনো শিবমন্দিরের ভিতরটা যেমন ভাঙাচোরা, তেমনই নোংরা।
চামচিকে, বাদুড়, সাপ আর বিছের আস্তানা। গদাই সেটাই যথাসাধ্য সাফসুতরো করে দিল। সাধুর ঠেক। ধুনি জ্বেলে সাধু সাধন-ভজন করে আর পাশেই গদগদ হয়ে গদাই বসে থাকে। লোকটা যে খুব উচ্চ কোটির সাধু, তাতে কোনও সন্দেহ নেই গদাইয়ের। কিন্তু বয়সটা বড্ড বেশিই ঠেকছে। গায়ের চামড়া এমন ঝুলে পড়েছে যে, সেই বাড়তি চামড়ায় আর-একটা লোককে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়। জটাজুট এতই বিশাল যে, পাকালে জাহাজ বাঁধার দড়ি হয়ে যায়। সেই সঙ্গে বুড়ো বয়সের যা দোষ, সেই ভীমরতিও একটু ধরেছে বলে গদাইয়ের ধারণা। মাঝে-মাঝেই সাধু জিজ্ঞেস করে, “এটা কোন জায়গা রে?”
“আজ্ঞে, এ হল প্রতাপগড়ের জঙ্গল।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলেছিলি বটে! পঁচাত্তর বছর আগে এরই কাছেপিঠে কোন গায়ে যেন এসেছিলাম, মনে পড়ছে না। আশপাশের গাগুলোর নাম জানিস?”
“তা আর জানব না বাবা! এই তো উত্তরে প্রতাপগড়, পুবে হল গে হবিবপুর, পশ্চিমে পটলডাঙা আর দক্ষিণে পায়েসপুর।”
“পায়েসপুর! হা হা, পায়েসপুরই তো সেই গায়ের নাম! সেখানে কী এক সর্বাধিকারী আছে না?”
“আজ্ঞে, আছে বইকী। নগেন সর্বাধিকারী। হাড়কঞ্জুস লোক। গতবার আমার কাছ থেকে বাতের তেল কিনে আজ অবধি দাম দেননি।”
“না না, নগেন নয়। অন্য নাম।”
“নগেনের বাবা ছিলেন বিশ্বেশ্বর। পঁচাত্তর বছর আগের কথা যখন বলছেন তখন উনিই হবেন।”
সাধুর চোখ ধক করে উঠল। বলল, “সে-ই। তাকেই আমি সেই পিদিম দিয়ে গিয়েছিলাম।”
“কীসের পিদিম বাবা?”
“সে খুব সাংঘাতিক পিদিম। যে ব্যবহার না জানে তার সর্বনাশ হয়ে যায়। আমি সেই পিদিম ফেরত নিতে এসেছি।”
সাধুর পদসেবা করতে-করতে গদাই জিজ্ঞেস করল, “তা বাবা, আপনার বয়স এখন কত হল? শতখানেক হবে না?”
“দুর! শতখানেক কী রে? ঠিক হিসেব নেই বটে, তবে পাঁচশো ছাড়িয়েছি।”
“ওরে বাবা!”
খুব মন দিয়েই সাধুর পদসেবা করে গদাই। দেখেশুনে তার মনে হচ্ছে পাঁচশো বছর বয়সি সাধু আর বেশি দিন নেই। ভীমরতিও একটু ধরেছে, ভুলভাল হচ্ছে। এসব লক্ষণ সে চেনে। সাধুর ভালমন্দ কিছু হয়ে গেলে সাধুর জিনিসপত্র তারই হাতে এসে যাবে। তখন আর তাকে পায় কে?
একদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গদাই দেখল, সাধুবাবা চিতপাত হয়ে অঘোরে ঘুমে। নাকও ডাকছে। বড্ড ইচ্ছে হল, সেই পাথরটা বের করে পাথরের কেরানিটা একটু নিজেই পরখ করে দ্যাখে। না, সে পাথরটা চুরিটুরি করবে না। ততটা আহাম্মক সে নয়। এই একটু দেখবে আরকী। সোনাদানা তো আর বিশেষ দেখেনি। এই মনে করে সে বিড়ালের মতো নিঃশব্দ পায়ে গিয়ে সন্তর্পণে ঝোলার মুখটা ফাঁক করে হাতটা ঢোকাতে যাবে, ঠিক সেই সময় ঘুমন্ত সাধুর মুখ থেকে একটা বজ্রনির্ঘোষ বেরিয়ে এল, “উঁহু!”
‘উঁহু’ শব্দটা যে এত উঁচু পরদায় বাঁধা যায় তা তার ধারণাই ছিল না। আঁতকে উঠে সভয়ে ফের সাধুর পায়ের দিকটায় গিয়ে
গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ল সে।
সকালে সাধু জ্বলজ্বলে চোখে চেয়ে বজ্রগম্ভীর স্বরে বলল, “ঝোলায় হাত দিয়েছিলি কেন?”
তাড়াতাড়ি সাধুর পা চেপে ধরে গদাই বলল, “আর হবে না। আপনি যে চোখ বুজেও দেখতে পান, সেটা খেয়াল ছিল না বাবা! পাপী মন তো?”
কিন্তু কৌতূহল এক সাংঘাতিক জিনিস। পরশপাথরের গল্প শোনা আছে বটে, কিন্তু চাক্ষুষ করেনি। একটু নেড়েঘেঁটে দেখার ইচ্ছেটা বড় আঁকুপাঁকু করছে মনের মধ্যে। সোনার বালাটা সে প্রতাপগড়ের বিধু স্যাকরাকে এক ফাঁকে দেখিয়ে এনেছে। কষ্টিপাথরে ভাল করে যাচাই করে স্যাকরা বলেছে, ‘জিনিসটা তো খাঁটিই দেখছি! তা কোথায় পেলি? চুরিটুরি করিসনি তো বাপু?
চুরি যে করেনি সেটা বলে লাভ নেই। গরিবের কথা কে আর বিশ্বাস করে? তবে গরিব নাম ঘোচাতে পারলে সব ব্যাটা কথার দাম দেবে।