মশাই, রাধাবাবুকে দেখলেই ফের হেসেটেসে ফেলব। রাধাগোবিন্দ বিস্ফারিত লোচনে কিছুক্ষণ কেপুবাবুর দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর হঠাৎ তার সমস্ত উত্তেজনা আর রাগ অন্তর্হিত হল। চোখদুটো আস্তে-আস্তে ছোট হয়ে এল এবং গোলাকার মুখটা হঠাৎ যেন চৌকোমতো হয়ে গেল। কেপুবাবু খুব তীক্ষ্ণ চোখে রাধাগোবিন্দবাবুর পরিবর্তনটা দেখছিলেন। এমনিতেই খুব লম্বা-চওড়া চেহারার রাধাগোবিন্দর শরীরটাও যেন হঠাৎ টনটনে শক্তপোক্ত হয়ে উঠল। নিকুঞ্জ বৈরাগী জনান্তিকে কেপুবাবুকে এই লক্ষণটার কথাই বলেছিল বটে! বলেছিল, ‘রাধাবাবু এমনিতে শান্তশিষ্ট হলে কী হয়, যখন এই লক্ষণগুলো দেখবেন, তখনই বুঝবেন যে, ওঁর ভিতরে একটা খ্যাপা ষাঁড় জেগে উঠেছে। তখন স্বয়ং যমও ওঁর সামনে দাঁড়াতে পারে না। বন্ধুডাকাতকে এই ভাবেই তো কাত করেছিলেন উনি। ঠিকমতো খেপিয়ে তুললে ওরকম ডাকাবুকো লোক ভূভারতে পাবেন না।
কেপুবাবুর দিকে স্থির চোখে চেয়ে হিমশীতল গলায় রাধাগোবিন্দ প্রশ্ন করলেন, “নিকুঞ্জ বৈরাগী কোথায়?”
কেপুবাবু তটস্থ হয়ে বললেন, “আহা, সে কি আর হাতের নাগালে বসে আছে দাদা? কোন থানায় ডিউটি দিচ্ছে কে জানে!”
“খগেন তপাদার কোথায়?”
কেপুবাবু মাথা নাড়া দিয়ে বললেন, “সেও গাঁয়ে নেই। তবে তাকেও সময়মতো ঠিকই পাওয়া যাবে।”
“ভূপেনদারোগা কোথায়?”
“তার কি আর নাওয়া-খাওয়ার সময় আছে দাদা? পাঁচটা গ্রাম রোদ দিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। চুরি-ডাকাতি যা বেড়েছে, কহতব্য নয়।”
“নবীনমাস্টার কোথায়?”
“এখন ইশকুলে কীসের যেন ছুটি চলছে, তাই নবীন বুঝি গত পরশুই মামাবাড়ি গেল!”
“মদনপাগলা কোথায়?”
“সে পাগলছাগল মানুষ, কোন আলায়বালায় ঘুরছে কে জানে? আমি বলি কী, সব কটাকে একসঙ্গে ঢিট করতে গেলে একটু ভজঘট্ট লেগে যাবে। আপনি বিচক্ষণ মানুষ, নিশ্চয়ই জানেন যে, প্রায়োরিটি বুঝে একটা-একটা করে কাজ সেরে ফেলতে হয়। সবক’টা একসঙ্গে নয়। তাই বলছিলাম, এখন সবচেয়ে জরুরি হল, সেই ছেলেধরা সাধুটার হাত থেকে আমাদের বটেশ্বরকে উদ্ধার করা।”
“সাধু কোথায়?”
“প্রতাপগড়ের জঙ্গলে। সে বড় ভয়ংকর জায়গা। দিনেদুপুরে লোক ঢুকতে সাহস পায় না।”
“প্রতাপগড়ের জঙ্গল কোথায়?”
“উত্তর দিকে। তা বলে হুট করে রওনা হয়ে পড়বেন না। সাধু হোক, ছেলেধরা হোক, সে সোজা পাত্র নয়। আমাদের পালোয়ান বটেশ্বরকে নেংটি ইঁদুরের মতো তুলে নিয়ে গিয়েছে। সুতরাং তার মোকাবিলার জন্য প্রিপারেশন দরকার। সঙ্গে একটা অস্ত্রট থাকলে ভাল হয়। অন্তত একটা লাঠি।”
রাধাগোবিন্দ ভারী অবাক হয়ে বললেন, “অস্ত্র! অস্ত্রের কী দরকার? এই দুটো হাতই যথেষ্ট!”
এই বলে রাধাগোবিন্দ দড়াম করে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন।
০৩.
গদাইয়ের হল কষ্টের কপাল। তা কেষ্ট পেতে গেলে কষ্ট তো কপালে আছেই। কিন্তু গদাই কেষ্ট চায় না, এবং তার দৃঢ় বিশ্বাস, কেষ্টও তাকে চায় না। তাই গদাইয়ের হল কেষ্টহীন কষ্টের জীবন। যে কাজটা মানুষের এক লহমায় হয়, গদাইয়ের হতে লাগে সাত দিন। এই যে কষ্ট করে-করে আদাড়েপাদাড়ে ঘুরে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সে সাপ ধরে বিষ আদায় করে নেয়, তার বদলে পায় ক’টাই বা পয়সা? অথচ সে শুনেছে, দশ-বিশ গ্রাম সাপের বিষের নাকি লাখো টাকা দাম। কিন্তু সীতেশবাবুকে কে বোঝাবে সে কথা? কখনও পঞ্চাশ, কখনও একশো টাকা ঠেকিয়ে বিদেয় করে দেন। তারপর ধনেশ পাখির তেল, মৃগনাভি, বাঘের দাঁত, চমরি গোরুর লেজ, পঞ্চমুখী রুদ্রাক্ষ, দক্ষিণাবর্ত শাখ, এসবেরও কি আর বাজার আছে? শুনলে লোকে নাক সিটকোয়। কাউকে গছাতে পারলেও নগদ দাম পাওয়া যায় না, সব বাকির খদ্দের। অনেকে আবার ভেজাল জিনিস মনে করে দুর-দুর করে তাড়িয়েও দেয়। এসব জিনিসের সমঝদার নেই মোটে।
দিনকাল যখন খুবই খারাপ যাচ্ছে, তখনই ঘটনা। সে প্রতাপগড়ের জঙ্গলে বিরল গাছগাছড়ার খোঁজে সারাদিন ঘুরে-ঘুরে হয়রান হয়ে ভাঙা কেল্লার লাগোয়া পুরনো শিবমন্দিরের চাতালে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। গরিবের তো ভয়ডর, শীত-গ্রীষ্ম, আরাম-আয়েশের ব্যাপার নেই। ভোজনং যত্রতত্র শয়নং হট্টমন্দিরে!
বুকে একটা খোঁচা খেয়ে ঘুম ভাঙল শেষ রাত্তিরে। চোখ চেয়ে দ্যাখে, সামনে এক বিভীষণ সাধু হাতে মশাল নিয়ে দাঁড়িয়ে। অন্য হাতে এক প্রকাণ্ড ত্রিশূল তার বুকে চেপে ধরে আছে। গদাইয়ের আত্মারাম তখন বুকের মধ্যে পাখা ঝাঁপটাচ্ছে। তবে বিপদআপদ নিয়েই বাস। তাই তাড়াতাড়ি হাতজোড় করে বলল, “পেন্নাম হই মহারাজ।”
“তুই কে?”
“আজ্ঞে, আপনার শ্রীচরণের দাস বলেই মনে করুন। লোক তেমন খারাপ নই, তবে বড় অনটন যাচ্ছে। মন্তর নিলে কি কিছু সুবিধে হবে বাবা?”
ভেবেছিল কুপিত সাধু বোধ হয় ত্রিশূলটা তার বুকে ঢুকিয়েই দেবে। অতটা অবশ্য করল না। ত্রিশুলটা সরিয়ে নিয়ে বলল, “তোর কীসের অনটন?”
গদাই তড়াক করে উঠে সাধুর পায়ে সাষ্টাঙ্গে একটা প্রণাম সেরে নিয়ে বলল, “আজ্ঞে, কিসের অনটন নয় বলুন বাবা! চাল, ডাল, নুন, তেল, কাপড়চোপড়, গাডু-গামছা, ঘরদোর, যার নাম করবেন তারই অনটন। সাপখোপ ধরে আর জড়িবুটি বেচে মোটেই চলছে না বাবা!”
সাধু জুলজুল করে তার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে বলল, “তোর হাতে ওটা কীসের বালা রে?”