রাধাগোবিন্দ মুখ না তুলেই মাথা নেড়ে বললেন, “রাধা নেই, বাজারে গিয়েছে।”
একটু বিস্মিত কেপুবাবু বললেন, “আপনি যে বর্তমানে নেই তা বুঝতে পারছি! কিন্তু বাজারেই কি এখন আপনাকে পাওয়া সম্ভব?”
রাধাগোবিন্দ সম্পূর্ণ মগ্ন অবস্থাতেই বললেন, “অ তা আছে বোধ হয় কোথাও, ভিতরে দ্যাখোগে।”
কেপুবাবু বিনয়ের সঙ্গেই বললেন, “কথাটা আপনার জানা দরকার। একটু কষ্ট করে অতীত থেকে যদি বর্তমানের দিকে আসেন, তা হলে ভাল হয়।”
‘দারোগার দীর্ঘশ্বাস’ লেখা থামিয়ে অগত্যা রাধাগোবিন্দ মুখ ফেরালেন। তারপর চিনতে পেরে বলে উঠলেন, “কেপুবাবু যে! তা কাকে খুঁজছিলেন যেন?”
“আপনাকেই।”
“আমাকে! কেন, আমি কোথাও গিয়েছিলুম নাকি?”
“তা তো বটেই। এখন আর তখনের মধ্যে আপনার নিত্যি যাতায়াত। তা যে কথাটা বলতে আসা। আপনি যে একজন
দারোগা ছিলেন, সেটা কি আপনার মনে আছে?”
“থাকবে না মানে? কত গুন্ডা-বদমাশ, চোর-চোট্টা, ডাকাত ছেলেধরা ঠান্ডা করেছি। রোমহর্ষক সব ঘটনা। বইটা বেরোলেই দেখবেন, কেমন ভীমরুলের চাকে ঢিল পড়ে!”
“সে তো বটেই। কিন্তু এত বড় ডাকসাইটে দারোগা হওয়া সত্ত্বেও আপনাকে কেউ পুঁছছে কি? এই যে সব বিদঘুঁটে কাণ্ড নাকের ডগায় ঘটে যাচ্ছে, আপনার কি মনে হয় না, গায়ের লোকের আপনার কাছে এসে পরামর্শ নেওয়া উচিত ছিল?”
“বটেই তো! কিন্তু গায়ে হচ্ছেটা কী?”
“কী হচ্ছে না বলুন? পায়েসপুরে বহিরাগত উগ্রবাদী ঢুকে বহাল তবিয়তে বসবাস তো করছেই, সেইসঙ্গে ফুটবল খেলছে, মারদাঙ্গা করে বেড়াচ্ছে। সাধুর ছদ্মবেশে ডাকাত ঢুকে নগেনবাবুকে হুমকি দিয়ে গিয়েছে, আর গতকাল বটেশ্বরকে মুক্তিপণের জন্য অপহরণ করা হয়েছে।”
অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে রাধাগোবিন্দ দাঁড়িয়ে পড়লেন, “ডাকাতি! মুক্তিপণ! ওরে শিগগির পিস্তলসমেত আমার ক্রস বেল্টটা নিয়ে আয়, আর ইউনিফর্মটাও দে।”
“আহা, অত তাড়া কীসের রাধাদা? স্থির হয়ে বসুন। এখন আপনি বর্তমানে আছেন, সেটা কি ভুলে গেলেন?”
রাধাগোবিন্দ একটু লজ্জিত হয়ে বললেন, “তাই তো! হ্যাঁ, কী যেন বলছিলেন? বটেশ্বর? তা কত মুক্তিপণ চেয়েছে?”
“এখনও চায়নি। তবে বটেশ্বরের বাবা করিতকর্মা লোক। আগে থেকেই কালেকশন তুলতে শুরু করেছে। আপনার বাড়িতেও এল বলে।”
“এ যে ঘোর অরাজকতা! এর তো বিহিত করা দরকার?”
“তা তো বটেই। আর সেই জন্যই তো আপনার কাছে আসা। দেশমাতৃকার তো এখন আপনার মতো সুসন্তানকেই দরকার। ঘাপটি মেরে গা ঢাকা দিয়ে থাকেন বলে কেউ টের পায় না যে, আপনিও এই পায়েসপুরের গৌরব। এই যে হারাধন পায়েসপুরের এত সুখ্যাতি করে বেড়ায়, সে কি ভুলেও একবার নাম উচ্চারণ করে? অথচ আপনি কার চেয়ে কম বলুন তো? এই যে মদনপাগলা আপনাকে জানালা দিয়ে বক দেখায়, এই যে খগেন তপাদার সেদিন চণ্ডীমণ্ডপে বসে বলছিল, “ওহে রাধাগোবিন্দ যেমন দারোগার দীর্ঘশ্বাস নামে বই লিখছে, তেমনই কালুচোরও নাকি পালটা আর-একখানা পুঁথি লিখে ফেলেছে, নাম দিয়েছে ‘দারোগার নাভিশ্বাস। তা লিখবে না-ই বা কেন? কালুকে ধরতে গিয়ে নাকি রাধাগোবিন্দ একবার কুকুরের তাড়া খেয়ে পুকুরে পড়েছিল, আর-একবার নয়নপুরের জলায় কাদায় পড়ে চার ঘণ্টা আটকে থাকে। ভুল করে নসিবপুরের যাত্রার দলের প্রম্পটারকে কালু মনে করে পাকড়াও করায় পাবলিকের কাছে হেভি ঠ্যাঙানি খায়। শেষে লোকে তার নামই দিয়েছিল ‘গাধাগোবিন্দ’। শুনুন কথা! আপনি চোখ-কান বুজে থাকেন বলে এসব কথা আপনার কানে যায় না, আর লোকেও আশকারা পেয়ে যায়। তাই বলছি, একটু গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বুক ফুলিয়ে গায়ে কয়েকটা চক্কর দিয়ে আসুন তো!”
রাধাগোবিন্দ হুংকার দিয়ে বলে উঠলেন, “বটে! আম্পর্দা তো বড় কম নয়!”
“আম্পদার কথা আরও শুনবেন? এই যে ভূপেনদারোগা এতবার করে গায়ে রোদ দিতে আসে, একটিবারও কি এসে আপনাকে সেলাম জানিয়ে যায়? সে কি জানে না যে, আপনি কত বড় একজন উঁদরেল দারোগা ছিলেন? লোকে তো শিখতেও আসে, না কি! তারপর ধরুন, এই যে নিধে হাজাম সেদিন আপনাকে খেউরি করে পয়সা নিয়ে গেল, সেটা কি তার উচিত হয়েছে? কে না জানে, পুলিশ-দারোগাদের সেবা করলে পুণ্যি হয়। খেউরির পয়সাটা সে তো ভেটই দিয়ে যেতে পারত! ওটুকু তো আপনার ন্যায্য পাওনার মধ্যেই পড়ে! ইশকুলের যে পুরস্কার বিতরণী সভা হয়ে গেল, তাতে গাঁয়ের সব ক’জন মান্যগণ্য লোককে ডাকা হল, শুধু আপনি বাদে। আমি নবীনমাস্টারকে যখন বললাম, ‘কাজটা কি ঠিক হল হে নবীন? রাধাগোবিন্দবাবুও তো একজন কেষ্টবিষ্ট লোক!” শুনে নবীন কিছুক্ষণ হাঁ করে থেকে চোখ কুঁচকে বলল, ‘কে, কার কথা বলছেন? রাধাগোবিন্দটা আবার কে? শুনুন কথা! সেই যে আপনার কনস্টেবল নিকুঞ্জ বৈরাগী, তার শ্বশুরবাড়ি তো এই পায়েসপুরেই। গত জামাইষষ্ঠীতে শ্বশুরবাড়ি এসেছিল, আমি গিয়ে বললাম, ‘ওহে নিকুঞ্জ, একবারটি তোমার বড়বাবুর সঙ্গে দেখা করে যাবে না?” নিকুঞ্জ কাঁঠাল খাচ্ছিল, খেতে-খেতেই হিহি হেসে বলল, ‘রাধাবাবুর কথা আর কবেন না কর্তা! ওঁর সামনে গেলে আমি হেসেই মরে যাব! আমি বেআদবটাকে বললাম, কেন? রাধাদাকে দেখে তো মোটেই হাসি পায় না?’ তখন বলল কী জানেন? বলল, ‘রাধাবাবু এমনই নিষ্কর্মা দারোগা ছিলেন যে, তাঁর আমলেই থানায় ডাকাতি হয়েছিল। আর রাধাবাবু ডাকাতের ভয়ে ইউনিফর্ম ছেড়ে আন্ডারওয়্যার পরে লকআপে কয়েদি সেজে ঘাপটি মেরে বসে ছিলেন। তাই দেখে ডাকাতদের সে কী হাসি! লুটপাট করে যাওয়ার আগে তারা রাধাবাবুকে সাত হাত নাকে খত দিইয়েছিল।