- বইয়ের নামঃ উঁহু
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ অদ্ভুতুড়ে সিরিজ
১. কার্তিক মাসের এই সকালবেলাটায়
উঁহু – অদ্ভুতুড়ে সিরিজ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
কার্তিক মাসের এই সকালবেলাটায় ঝলমলে রোদ আর মিঠে হাওয়ায় পায়েসপুরের চারদিকেই একটা প্রসন্ন ভাব। সদানন্দ গান গেয়ে ভিক্ষে করতে বেরিয়েছে। তার গলায় সুর নেই বটে, কিন্তু চেষ্টা আছে। কেপুবাবু তাঁর ভোলা বারান্দায় মোড়া পেতে বসে একটা খবরের কাগজ পড়ছেন, যদিও কাগজখানা সাত দিনের পুরনো। আসলে তিনি পড়ছেন না, ওইভাবে রোজই তিনি চারদিকে নজর রাখেন। রাধাগোবিন্দবাবু তার বাইরের ঘরে জানালার কাছে টেবিলের ধারে চেয়ার পেতে বসে আত্মমগ্ন হয়ে তার আত্মজীবনী লিখছেন। প্রথমে বইয়ের নাম দিয়েছিলেন ‘এক বীরের আত্মকথা’। তারপর সতেরোবার নাম বদল করে ইদানীং নাম দিয়েছেন ‘দারোগার দীর্ঘশ্বাস’। এই নামও হয়তো বদলে যাবে। তবে এই বইয়ে নানা দুর্ধর্ষ অভিযান এবং রোমহর্ষক লড়াইয়ের কথা আছে বলে শোনা যায়। বই বেরোলে বনমালীর মোচার চপের মতোই দেখ-না-দেখ বিকিয়ে যাবে বলে তার ধারণা। আজ সকালে হারানবাবু তার চশমা খুঁজে পাচ্ছেন না। গতকাল তার নস্যির ডিবে হারিয়েছিল। পরশু হারিয়েছিল তার হাওয়াই চটির একটা পাটি। তার আগের দিন গায়েব হয়েছিল তার হাতঘড়ি। হারানবাবুর নাম মোটেই হারান নয়। তার নাম হারাধন খাড়া। কিন্তু প্রায়ই জিনিস হারিয়ে ফেলেন বলে লোকে তার নাম রেখেছে হারান।
কদমতলায় বসে মদনপাগলা একটা ঝাটার কাঠি দিয়ে মাটিতে আঁক কাটতে কাটতে বলছে, “দুইয়ে-দুইয়ে চার হয় সে না হয় বুঝলুম, তিনে দুইয়ে পাঁচ হয় এটাও না হয় মেনে লওয়া গেল, কিন্তু চারটে জিলিপির সঙ্গে দু’টো শিঙাড়া যোগ করলে কেমন হয় সেটাই বোঝা যাচ্ছে না।”
তারক তর্কালঙ্কার বাজার করে ফিরছিল, উলটো দিক থেকে আসছিল সবজান্তা জয়লাল। জয়লালকে দেখেই তারক মুখ ঘুরিয়ে তাড়াতাড়ি নবীনমাস্টারের বাড়ির ফটকের কাছে গিয়ে হাঁক মারল, “কই হে মাস্টার, এসো তো, আজ রিলেটিভিটি নিয়ে একহাত হয়ে যাক।”
ওদিকে জয়লালও তারককে দেখে বিপরীত দিকে হাঁটা দিয়ে গোপালময়রার দোকানে ঢুকে পড়ে বলতে লাগল, “দেদো সন্দেশ তৈরির কায়দাটা একদিন তোমাকে শিখিয়ে যাব হে গোপাল।”
আসলে তারক আর জয়লালের ইদানীং ঝগড়ার জের চলছে। কেউ কারও মুখদর্শন করে না। ব্যাপারটা হয়েছিল কী, একদিন মদনপাগলার খুব বাই উঠেছিল, মেঘের খিচুড়ি খাবে। একটা মেটে হাঁড়ি নিয়ে মেঘ ধরার জন্য ইটভাটার মাঠে ঘাপটি মেরে বসে ছিল। তাই দেখে জয়লাল অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলেছিল, “হুঃ, মেঘের খিচুড়ি। এর পর শুনব আকাশের পায়েস, জলের বেগুনি, বাতাসের চচ্চড়ি এসবও হবে। পাগল আর কাকে বলে!”
জয়লালের মন্তব্যটা তারকের তেমন পছন্দ হল না। সে বরাবর মনে-মনে ধারণা করে এসেছে যে, মদনপাগলা সাধারণ পাগল নয়, জ্ঞানী পাগল। তাই সে বলল, “মেঘের খিচুড়ি হবে না কেন হে! মেঘ থেকে বৃষ্টি হয়, আর বৃষ্টির জল ধরে তাই দিয়ে খিচুড়ি বঁধলেই হল। মদনের কথার ভিতর একটা ডেপথ থাকে, বুঝেছ! তলিয়ে বুঝতে হয়।”
এ কথায় চটে গিয়ে জয়লাল বলল, “তা বৃষ্টির জল তো পুকুরটুকুরেও পড়ছে, সেই জল দিয়ে খিচুড়ি রাঁধলে সেটাও কি তোমার ওই মেঘের খিচুড়ি নয়?”
তারক দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, “না, তা নয়! ডাইরেক্ট বৃষ্টির জলের মধ্যে যে ইলেকট্রিসিটি থাকে, তা পুকুরে পড়লে নষ্ট হয়ে যায়। দ্যাখোনি, গ্রীষ্মকালে বৃষ্টি না হলে লঙ্কার ঝাল কমে যায়। যতই জল ছিটোও না কেন, কিছুতেই ঝাল আসে না। কিন্তু যেই দু’ ফোঁটা বৃষ্টির জল লঙ্কাগাছে পড়ল, অমনি চিড়বিড়িয়ে উঠল তার ঝাল।”
এই নিয়েই দু’জনের ঝগড়া তুঙ্গে উঠে গেল। গত পনেরো দিন তাদের বাক্যালাপ, মুখদর্শন বন্ধ।
‘ইন্ধনহীন রন্ধন’ নামে এক আশ্চর্য উনুন আবিষ্কার করে প্রযুক্তিবিদ হলধর ঘোষ সারা গায়ে হুলস্থুল ফেলে দিয়েছিলেন। কয়লা, কাঠ, গ্যাস বা বিদ্যুৎ, এমনকী, সৌরশক্তি ছাড়াই তাতে রান্না হওয়ার কথা। দুঃখের বিষয়, শেষ অবধি সেই চুল্লিতে অনেক চেষ্টায় একবাটি জল একটুখানি গরম হয়েছিল মাত্র। হলধরের আবিষ্কৃত ‘অটো মিস্তিরি’ নামক আশ্চর্য যন্ত্রের রেডিয়ো, টিভি বা যে-কোনও বস্তু মেরামত করার কথা। কার্যত কী একটা গোলযোগে সেটা আজও চালু করা যায়নি। তাঁর অটো ইস্তিরি যন্ত্র তত আরও সরেস। ধুতি, পাঞ্জাবি, শার্ট, প্যান্ট, শাড়ি অতি যত্নে ঠিকঠাক ভাজ ও ইস্তিরি করে দিতে পারে। কী একটা সামান্য উপকরণের অভাবে সেটাও এখনও সচল হয়নি। তবে এসব ছাড়াও হলধর বিস্তর জিনিস আবিষ্কার করে থাকেন, কিন্তু সেগুলোর উপযযাগিতা কী তা এখনও ভেবে উঠতে পারেননি।
গত কয়েকদিন একটি আবিষ্কার নিয়ে মগ্ন ছিলেন হলধর। কাল সারারাত জেগে আজ ভোরেই তাঁর কাজ শেষ হয়েছে। আনন্দে ডগমগ করতে-করতে তিনি বাইরের ঘরে ঢুকে হুংকার দিয়ে বললেন, “ইউরেকা! ইউরেকা!”
বাইরের ঘরে খগেন তপাদার, নিমাই বিশ্বাস, ব্ৰজেন বোস, গজপতি রায়, নগেন সর্বাধিকারী প্রমুখ গাঁয়ের মাথা-মাথা লোকেরা বসে গুলতানি করছেন। রোজই করেন। কারণ, হলধরের বাড়িতে রোজই সকালে ফুরফুরে চিড়েভাজা আর সুগন্ধি চায়ের ব্যবস্থা থাকে। ইউরেকা’ শুনে কেউ বিশেষ উদ্বেলিত হলেন না। কারণ, তারা এই ঘোষণা প্রায়ই শুনে থাকেন। গজপতি রায় বললেন, “তা কী জিনিস আবিষ্কার করলে হে?”