ভোলারাম কেঁপে-ফেঁপে অস্থির। বলল, “আজ্ঞে না।”
“না হলেই ভাল। আজ পর্যন্ত আমার পয়সা কেউ হজম করতে পারেনি কিনা।”
আর ওই যে গুন্ডা চণ্ডী, তার ভয়ে সবাই থরহরি। কিন্তু চণ্ডীও নগেনের চোখে চোখ রেখে কথা কওয়ার সাহস পায় না। নিশিন্দাপুরে নগেনের বাগানবাড়িতে কালোেচরণ দাসের মতো সাংঘাতিক হেক্কোরকে বেয়াদবির জন্য ডান হাতের কবজি মুচড়ে ভেঙে দিয়েছিল নগেন। অথচ কালো একজন পালোয়ান লোক। সেই থেকে চণ্ডী কখনও নগেনের সঙ্গে পাঙ্গা নেওয়ার কথা ভাবেও না।
টাকাটা উদ্ধার করা শক্ত কিছু ছিল না। ভোলারাম আর চণ্ডী এক রাতে গিয়ে বুড়ির উপর চড়াও হল। বেশি কিছু করতেও হয়নি, গলায় একখানা দা চেপে ধরতেই বুড়ি হাউমাউ করে বলে দিল, “উঠোনে পুবধারে কাঁঠাল গাছের তলায় পোঁতা আছে বাবা। প্রাণটা রক্ষে করো, ও তোমরা নিয়ে যাও।”
কাঁঠাল গাছের তলা বেশি খুঁড়তেও হয়নি। হাতখানেক গর্তের নীচেই পিতলের ডাবরখানা ছিল। তাতে পাঁচ লাখ নগদ টাকা।
সুতরাং সব দিক দিয়েই সুষ্ঠু সমাধান হয়ে গিয়েছিল। পল্টুকে জেল থেকে ছাড়িয়ে এনে নামধাম পালটে অনেক দূরে কোথাও পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার বদলে ফাঁসি যাওয়া একরকম ঠিকই হয়ে ছিল নবীন দাসের। পাঁচ লাখ টাকাও উদ্ধার হয়ে গিয়েছে। সুতরাং নগেন নিশ্চিন্ত ছিল। ফঁসিটা মানে-মানে হয়ে গেলেই হল।
ঠিক এই সময়ে খবর এল যে, নবীন পালিয়েছে। বিনা মেঘে বজ্রাঘাত! নবীন পালিয়েছে মানে বিপদ। যদি ধরা পড়ে, তা হলে সব ষড়যন্ত্রটাই ফাঁস হয়ে যাওয়ার কথা। পুলিশ এসে নগেনের বাড়ি রোজ তছনছ করতে লাগল পলু পাকড়াশির খোঁজে।
নগেন ঠান্ডা মাথার লোক। মোটেই উত্তেজিত হল না। চণ্ডীকে ডেকে বলল, “নবীন পালিয়েছে বটে, কিন্তু ওর লোকবল বা অর্থবল নেই। বড় জোর ছুটে আর হেঁটে কোথাও গিয়ে গা ঢাকা দিয়েছে। বেঁচে থাকলে আমাদের বিপদ। কারণ, ধরা পড়ে অনেক কথা কইবে। সুতরাং পুলিশ ওকে জেরা শুরু করার আগেই নিকেশ করা চাই। এমন ব্যবস্থা করে আসবি, যাতে লাশ শনাক্ত করা না যায়।”
দু’জন সঙ্গী নিয়ে চণ্ডী বেরিয়ে পড়ল।
পল্টুর পালানোর খবর পেয়েছিল শিবতলার ভুবন মণ্ডলও। ভুবন মণ্ডলকে দৈত্য বললেও বলা যায়। যেমন তাল গাছের মত ঢ্যাঙা, তেমনই পালোয়ানি চেহারা। ভয় বস্তুটি কী, তা তার জানা নেই। সে যদি ষণ্ডামি-গুন্ডামির পন্থা নিত, তা হলে গোটা পরগনায় তার জুড়ি কেউ থাকত না। কিন্তু ভাগ্যক্রমে ভুবন মণ্ডল ধর্মভীরু মানুষ। মেজাজও ঠান্ডা। কিন্তু একটা মুশকিল হল, যদি কোনও কারণে সে হঠাৎ রেগে যায়, তা হলে চারপাশে কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে ছাড়ে। তখন আর তার কাণ্ডজ্ঞান বলে কিছু থাকে না। বছর দুই আগে তার সহোদর ভাই গগন মণ্ডল যখন বাজিতপুরে খুন হয়, তখনও একবার মাথায় খুন চেপেছিল তার। কিন্তু খুনিটা কে, তা জানা ছিল না বলে সে কয়েকটা মোটাসোটা গাছ দু হাতে উপড়ে আর কয়েকটা পাথর কিলিয়ে ভেঙে রাগটা প্রশমিত করে। তারপর যখন খুনি পল্টু পাকড়াশি ধরা পড়ে, তখন সে পল্টুকে গলা টিপে মারবে বলে প্রথমে আদালতে, পরে লকআপেও হানা দেয়। কিন্তু পুলিশের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারেনি। তবে শেষ পর্যন্ত পল্টুর ফাঁসির হুকুম হওয়ায় সে খানিকটা ঠান্ডা হতে পেরেছিল।
পল্টু পালিয়েছে শুনে ভুবন মণ্ডলের শান্ত মাথাটায় আবার দপ করে আগুন জ্বলে উঠল।
তবে সে তাড়াহুড়ো করল না। এটা সে জানে যে, কলেবরটা বিরাট হলেও এবং গায়ে অসুরের জোর থাকলেও তার বুদ্ধি খুব একটা বেশি নয়। এর আগে গোঁয়ার্তুমি করতে গিয়ে সে বিস্তর ঝামেলায় পড়েছে। তাই মাথা ঠান্ডা রাখার জন্য বড় একখানা বগিথালায় একথালা পান্তাভাত, একছড়া তেঁতুল আর আখের গুড় দিয়ে সাপটে মেরে দিল সে। তারপর অনেকক্ষণ ধরে তার প্রিয় কুড়ুলখানা পাথর আর শিরীষ কাগজে ঘষে ভাল করে ধার তুলল। খাটো ধুতিখানা আঁট করে মালকোচা মেরে পরে ফেলল। গায়ে খাটো পিরানখানা চাপিয়ে মা কালীকে পেন্নাম ঠুকে বেরিয়ে পড়ল।
বিশু গায়েনের সঙ্গে যে গোখরো সাপের খুব মিল আছে, এটা অনেকেই মানে। হিলহিলে পাকানো চেহারা, চোখে হিমশীতল চাউনি আর প্রখর বুদ্ধি।
কালীপদ নস্কর ছিল বিশুর জামাই। কালীপদ পল্টুরই বয়সি, ইয়ারবন্ধুও বটে। ব্যাবসাও করত একসঙ্গে। সেই ব্যাবসা নিয়েই একদিন বচসা হল, ঝগড়াঝাটি হল। মুখ দেখাদেখিও বন্ধ হয়ে গেল। তারপর কী হল কে জানে, একদিন ভোরবেলা এসে ঘুমন্ত অবস্থা থেকে তুলে কালীপদকে উঠোনে টেনে নিয়ে গিয়ে তার বউয়ের সামনেই খুন করে রেখে গেল পল্টু। বিশুর ওই একটাই সন্তান, মেয়ে মানময়ী। মাত্র আঠেরো বছর বয়সেই বিধবা মানময়ী এখনও হাহাকার করে রোজ কাঁদে। বিশুর সহ্য হয় না। পল্টুর ফাঁসির খবরে মেয়েটা একটু দম ধরেছিল।
বিশু অবশ্য কখনওই ভোলেনি। এখন পল্টুর জেল থেকে পালানোর খবর পেয়ে সে সকালবেলাতেই বেরিয়ে পড়ল। আশপাশের সব গাঁয়েই তার চেনা লোক আছে। তার ধান আর শস্যবীজের গাহেক সর্বত্র। লোকে তাকে ভয় পায়, খাতিরও করে।
লাটপুরের গন্ধর্ব সেনাপতি বলল, “পাকা খবর জানি না, তবে অষ্টপুর থানায় একজন ফেরারি আসামি ধরা পড়েছে বলে কানাঘুষো শুনেছি। দেখোগে যাও।”