নবীন হাঁ করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, “নামিনি তো!”
“নামোনি! কিন্তু পষ্ট যে নিজের চোখে তোমার কাণ্ডটা দেখলুম।”
নবীন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। চোখে জলও আসছিল তার। আর যাই হোক, তাদের বংশের কারও চোর বদনাম নেই। নবীনই বোধ হয় প্রথম এই কাজ করে ফেলেছিল। এখন তার বড্ড অনুতাপ হচ্ছে। সেই পাপের জন্য এখন যদি তার ফাঁসিই হয়, সেও ভি আচ্ছা। ফঁসিই হোক।
“ও বাপ! চোখে জল দেখছি! বলি, মরদ মানুষের চোখে জল কেন হে বাপু? কঁচা কাজ করলে তো কেলেঙ্কারি হবেই। হাত পাকিয়ে তবে না কাজে নামতে হয়।”
“আমি চোর নই। হাত পাকানোরও দরকার নেই। আপনি যান।”
লোকটা তার দিকে আরও কিছুক্ষণ জুলজুলে চোখে চেয়ে থেকে বলে, “চোর নও? তবে গায়ে কয়েদির পোশাক কেন?”
“সে অনেক কথা। আমি ফাঁসির আসামি।”
“বাবা। তবে তো শাহেনশা লোক হে। ক’টা খুন করেছ?”
“একটাও না।”
“বটে? তা হলে ফাঁসি হচ্ছে কোন সুবাদে?”
“সে আপনি বুঝবেন না। কপাল খারাপ হলে কত কী হয়! কিন্তু আপনি কে বলুন তো?”
“আমার নাম উদ্ধব খটিক। সেদিন তোমার কাণ্ড দেখে ভেবেছিলুম, সুযোগ পেলে তোমাকে একটু তালিম দেব, কিন্তু এখন দেখছি সবাইকে দিয়ে সব কাজ হওয়ার নয়। চোর, বাটপাড়, খুনে, গুন্ডা-বদমাশ আমি বিস্তর দেখেছি। কিন্তু তোমাকে দেখে কোনওটাই মনে হচ্ছে না। যাক গে, তোমার গায়ের বিষ আগে মরুক, তারপর তোমার ঘটনাটা শোনা যাবে।”
উদ্ধব খটিক চোখের পলকে উধাও হয়ে গেল।
.
কে যেন জিজ্ঞেস করছিল, “বড়বাবু কি বাড়িতে আছেন? বড়বাবু কি বাড়িতে আছেন?”
প্রাণপতি খাসনবিশ কথাটার অর্থ কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। কে বড়বাবু, কেনই বা তিনি বাড়িতে থাকতে যাবেন, এসব তার কাছে হেঁয়ালি বলেই মনে হচ্ছিল। সামনে কে একটা আবছা মতো দাঁড়িয়েও আছে বটে, কিন্তু সেটা অলীক বা কুহেলিকাও হতে পারে।
কিন্তু দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চমবারও একই প্রশ্ন বারবার হাতুড়ির মতো তাঁর কানে এসে পড়ায় হঠাৎ তিনি সচকিত হয়ে উঠলেন। তাই তো! প্রশ্নটা তো তাকেই করা হচ্ছে বটে! এবং তিনিই তো অষ্টপুর থানার বড়বাবু বটে!
তিনি শশব্যস্তে সোজা সটান হয়ে বসে চারদিকটা ভাল করে
দেখে নিয়ে বললেন, “না না, আমি এখন বাড়িতে নেই তো! আমি
তো থানায় বসে আছি বলেই মনে হচ্ছে।”
সামনের চেয়ারে বসা একটা লোক হেসে বলল, “যে আজ্ঞে, আপনি থানাতেই বসে আছেন। আপনি নিজের মধ্যে আছেন কি না, সেটাই জানতে চাইছিলাম।”
লোকটা অবনী ঘোষাল, শ্রীনিবাস আচার্যির ছোট জামাই এবং এই লোকটাই যত নষ্টের গোড়া। পলু পাকড়াশিকে গণধোলাই দেওয়ানোর মূলে ছিল এরই প্ররোচনা। আর তার ফলেই খুনের আসামিটাকে নিয়ে প্রাণপতিকে ঝামেলা পোয়াতে হচ্ছে। এই মরে কি সেই মরে।
মুখে খাতির দেখিয়ে প্রাণপতি বললেন, “অবনীবাবু যে, বসুন, বসুন।”
অবনী গম্ভীর মুখে বলে, “আমি তো বসেই আছি।”
“ওঃ, তাই তো! হ্যাঁ, কী যেন বলছিলেন?”
“এখনও বলিনি। তবে বলতেই আসা। আপনি কি জানেন, সরকার বাহাদুর ওই মারাত্মক খুনি আর ফেরারি আসামিকে ধরার জন্য কোনও পুরস্কার ঘোষণা করেছে কি না।”
“আজ্ঞে না, এখনও ঘোষণা হয়নি।”
“হবে বলে কি মনে হয়?”
“তা হতেও পারে।”
“তা হলে পুরস্কারটা কিন্তু আমারই পাওনা। আপনি আমার কথা কি উপর মহলে জানিয়েছেন?”
“আমাদের এফ আই আর-এ স্পষ্ট করেই সব লেখা আছে অবনীবাবু। মিস্টার অবনী ঘোষাল, দি সন-ইন-ল অফ শ্রীনিবাস আচার্য, অ্যাপ্রিহেন্ডেড দি কালপ্রিট পল্টু পাকড়াশি অলমোস্ট সিঙ্গল হ্যান্ডেডলি অ্যান্ড বাই হিজ ওন এফোর্ট। বাট দি আইরেট অ্যান্ড আনরুলি ক্রাউড ম্যালহ্যান্ডলড দি কালপ্রিট ভেরি ব্যাডলি।”
“বাঃ, বেশ লিখেছেন মশাই। কিন্তু পুরস্কারটা ঘোষণা হচ্ছে না কেন বলুন তো! আমি তো ঠিক করে রেখেছি, টাকাটা পেলেই একখানা ভাল দেখে মোটরবাইক কিনে ফেলব।”
“সে আর বেশি কথা কী। তবে কিনা সরকার বাহাদুর পুরস্কার যদি দেয়, তা হলে জ্যান্ত পল্টু পাকড়াশির জন্য দেবে। কিন্তু ছোঁকরার যা অবস্থা, তাতে বাঁচলে হয়।”
“সর্বনাশ! বাঁচবে না মানে? না বাঁচলে ছাড়ব নাকি? আপনি ওর ভাল রকম চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। দরকার হলে আমি চিকিৎসার খরচ দেব। ফল, মাছ, দুধ, ভিটামিন সব দিন। এই হাজারখানেক টাকা রেখে যাচ্ছি। কোনও অযত্ন না হয় দেখবেন।”
“যে আজ্ঞে। আপনার মনটা বড্ড নরম।”
৪. নবীনকে যেদিন জেলখানায়
নবীনকে যেদিন জেলখানায় পাঠাল, তার পরদিন সকালেই নগেন পাকড়াশি ভোলারাম আর চণ্ডীচরণকে ডেকে বলল, “এবার টাকাটা যে উদ্ধার করে আনতে হয় বাপু। দেরি করলে বেহাত হয়ে যেতে পারে।”
ভোলারাম বলে, “ও নিয়ে ভাববেন না। আমাদের লোকেরা আগাগোড়া নজর রেখেছে। নবীনের পাতানো এক পিসি আছে, ননীবালা। অনেক বয়স। টাকাটা তার হেফাজতেই আছে।” নগেন ঠান্ডা গলায় বলল, “আজই উদ্ধার করা চাই।” নগেনকে সমঝে চলে না, এমন লোক তল্লাটে নেই। ভোলারাম একবার বিচালিঘাটের এক মহাজনের কাছে নগেন পাকড়াশির দশ লাখ টাকা পৌঁছে দিতে যাচ্ছিল। এত টাকা হাতে পেয়ে তার একবার মনে হয়েছিল, টাকাটা নিয়ে পালিয়ে যায়। চিরতরে ভিনদেশে পালিয়ে গেলে নগেন তার নাগাল পাবে না।
আর সেদিনই হঠাৎ টাকার বান্ডিলটা তার হাতে দিয়ে নগেন ভারী আদুরে গলায় জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁ রে ভোলা, এই যে তুই মাঝে-মাঝেই এত এত টাকা একে-ওকে পৌঁছে দিয়ে আসিস, তা তোর কখনও লোভ হয় না? ইচ্ছে হয় না, টাকাটা গাপ করে পালিয়ে যেতে?”