সম্ভব শেষ পথটুকু পেরনোর চেষ্টা করছে। পৌঁছেই গিয়েছে প্রায়। আর একটু…
সুড়ঙ্গের মুখে একটা লোক হামাগুড়ির ভঙ্গিতেই খাপ পেতে বসে তাকে জুলজুল করে দেখছে। মাথায় কঁকড়া চুল, কটা চোখ, তোম্বাপানা মুখ। তার দিকে একখানা হাত বাড়িয়ে বলল, “হাতটা চেপে ধরো হে, টেনে তুলে নিচ্ছি।”
হাঁফাতে হাঁফাতে নবীন খপ করে হাতটা চেপে ধরল। কিন্তু মুশকিল হল, নবীনের পিছন দিকেও একটা টান আছে। লোকটা হেঁইও জোরে টানছে বটে, কিন্তু নবীনকে ঠিক টেনে তুলতে পারছে না। বিরক্ত হয়ে বলল, “আহা, তোমার কি বেরিয়ে আসার গা নেই নাকি? একটু চাড় মেরে বেরিয়ে আসতে পারছ না?”
নবীন কাঁচুমাচু হয়ে বলে, “চেষ্টা তো করছি মশাই, কিন্তু কেবল পিছলে নেমে যাচ্ছি যে!”
লোকটা আরও খানিকক্ষণ দাঁতমুখ খিঁচিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করে হাল ছেড়ে দিয়ে বলে, “না হে বাপু, তোমার বেরিয়ে আসার ইচ্ছেটাই নেই। কিন্তু বাপু, ফিরে গিয়ে লাভটা কী বলো তো! সেই তো বিষব্যথার মধ্যে গিয়ে পড়বে। তোমার সর্বাঙ্গে ক’টা কালশিটে জানো? গুনে দেখেছি, দুশো ছাপান্নটা। তিন জায়গায় হাড়ে চিড় ধরেছে। নাক-মুখ-চোখ ফুলে ঢোল, মাথায় দুটো ঢিবি। আর ক্ষতস্থানের তো লেখাজোখা নেই। এক কলসি রক্তপাত হয়েছে, ও শরীরের আর আছেটা কী বলো তো? ফিরে গিয়ে ব্যথা-বেদনায় ককিয়ে মরতে হবে। আর যদি বেঁচেও যাও, ফের গিয়ে ফাঁসিতে লটকাবে। আর যদি ফাঁসি না-ও হয়, তা হলে নগেন পাকড়াশি তোমাকে ছেড়ে কথা কইবে ভেবেছ? এতক্ষণে বোধ হয় দা, কুড়ুল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। তাই তোমার ভালর জন্যই বলছি হে, একটা হেস্তনেস্ত করে উঠে এসো তো বাপু।”
“একটু জিরোতে দিন। তারপর ফের চেষ্টা করছি। কিন্তু আপনি কে?”
“আমি হলুম খগেন দাস, ফস্টারসাহেবের খাজাঞ্চি।”
“ফস্টারসাহেব কে?”
“মস্ত কুঠিয়াল ছিলেন হে। তরোয়াল দিয়ে কত মুন্ডুই যে কেটেছেন!”
“ওরে বাবা!”
“আহা, তোমার ভয় কী? তুমি নাকি ভারী ভাল কবাডি খেলতে পারো?”
একগাল হেসে নবীন বলে, “তা পারি।”
“তবে তো হয়েই গেল। ফস্টারসাহেব কবাডি খেলার পাগল। নাও বাপু, অনেকক্ষণ জিরিয়েছ, এবার হাতটা যেন কষে চেপে ধরো তো! এক ঝটকায় তোমাকে বের করে আনছি!”
তা ধরল নবীন, কষেই ধরল। কিন্তু পিছনের টানটা বড্ড জোর লেগেছে। সে ফের পিছলে নেমে যাচ্ছে নীচে।
খগেন দাস অবশ্য বেশ পালোয়ান লোক। ফের তাকে খানিক টেনে তুলে বলল, “ইচ্ছেশক্তিকে কাজে লাগাও হে, এই অন্তিম মুহূর্তটাই গোলমেলে। চাড় মারো, জোরসে চাড় মারো।”
তা মারছিল নবীন। একটু উপরের দিকে উঠলও যেন! খগেন বলল, “আর শোনোনা, খবরদার ওই ঝাড়ুদারটার সঙ্গে ভাব করতে যেয়ো না যেন! খুব খারাপ লোক।”
অবাক হয়ে নবীন বলে, “কে ঝাড়ুদার? কার কথা বলছেন?”
“ওই যে শীতলসাহেবের গির্জা ঝাঁটায় যে লোকটা, ওর নাম পল। একদম পাত্তা দিয়ো না ওকে। ওর মাথার ব্যামো আছে।”
“যে আজ্ঞে, তাই হবে। কিন্তু আমি যে আর পেরে উঠছি না মশাই, আমার পা ধরে কে যেন বেজায় জোরে টানছে।”
“আহা, সে তত টানবেই। ঝটকা মেরে পা ছাড়িয়ে নাও, তারপর উঠে এসো। শরীরটা ছেড়ে গেলেই দেখবে ফুরফুরে আরাম লাগবে।”
কিন্তু নীচের দিকের টানটাই বড্ড বেশি হয়ে উঠল। খগেন দাসের জোরালো মুঠিও ঠিক সামাল দিতে পারল না। হাতটা হড়কে গিয়ে সুড়ঙ্গ বেয়ে সুড়সুড় করে নীচে নামতে লাগল নবীন। তার পর ঝড়াক করে এক জায়গায় থামল। আর থামতেই মনে হল, চারদিক থেকে যেন হাজারটা ভিমরুল হুল দিচ্ছে তাকে। সর্বাঙ্গে অসহ্য যন্ত্রণা। মাথা টনটন করছে, গাঁটে-গাঁটে যন্ত্রণার হাট বসে গিয়েছে, কানে ঝিঁঝি ডাকছে, চোখে অন্ধকার দেখছে সে।
খানিকক্ষণ পর নবীন বুঝতে পারল যে, মরতে মরতেও সে মরেনি। তার হাত-পা অবশ হলেও একটু-আধটু নাড়াচাড়া করতে পারছে। তার গায়ে বোধ হয় খুব জ্বর। বড্ড শীতও করছে তার।
তার মাথাটা তুলে কে যেন তাকে কিছু একটা খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। গরম দুধ নাকি? তাই হবে বোধ হয়। তবে দুধে কেমন একটা স্পিরিট-স্পিরিট গন্ধ।
আবার ঘুমিয়ে পড়ল নবীন। ঘুমনোর আগে আবছা শুনতে পেল, কে যেন কাকে জিজ্ঞেস করছে, “ছেলেটা কি বাঁচবে?”
“বলা যাচ্ছে না। ইনফেকশন না হলে বেঁচে যেতেও পারে।”
“বেঁচেই বা কী লাভ? শুনছি ফাঁসির আসামি।”
ওই ‘ফাঁসির আসামি’ কথাটা কানে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল নবীন। কতক্ষণ পর তার ঘুম ভাঙল, কে জানে। কিন্তু ঘুম ভাঙতেই তার মনে পড়ল, সে ফাঁসির আসামি।
শরীরে প্রচণ্ড যন্ত্রণা এখন একটু যেন সহ্যের মধ্যে এসেছে। চোখ দুটো পুরো খুলতে পারছে না বটে, কিন্তু সামান্য একটু ফাঁক করতে পারছে। আবছা চোখে সে গরাদের আভাস দেখতে পেল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। পালিয়েও লাভ হল না। এরা আবার ধরে এনেছে তাকে। ফাঁসিতেই ঝোলাবে। ভারী হতাশ হয়ে চোখ বুজল নবীন। খগেন দাস ঠিকই বলেছিল, সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে যেতে পারলেই বোধ হয় ভাল হত।
গরাদের ওপাশে কে একজন যেন এসে দাঁড়িয়েছে।
গরাদের ওপাশে যে লোকটা পঁড়িয়ে আছে, সে লম্বা, রোগা, পরনে লুঙ্গি আর গায়ে কামিজ। বয়স চল্লিশের উপর। গালে রুখু দাড়ি আর গোঁফ। জুলজুল করে তাকে দেখছিল।
নবীন চোখ খুলতে লোকটা উবু হয়ে বসে বলল, “কত কাল লাইনে নেমেছ বাপু?”