এইরকম নানা গুরুতর চিন্তায় তাঁর মাথা সর্বদা ব্যাপৃত থাকে। আর থাকে বলেই নিজের ধড়টাকে তাঁর সব সময় খেয়াল থাকে না। আর থাকে না বলেই মাঝে-মাঝে নীচের দিকে তাকিয়ে তিনি ভারী অবাক হয়ে যান। কারণ মুন্ডুর নীচে, অর্থাৎ ঘাড়ের তলা থেকে তাঁর পরনে পুলিশের পোশাক, কোমরে চওড়া বেল্ট ও ভারী পিস্তল।
প্রাণপতিবাবুর মুন্ডুর সঙ্গে ধড়ের এই খটাখটি বহুকালের। দু’ পক্ষের বনিবনা নেই বললেই হয়।
মাঝে-মাঝে তাঁর ফচকে হেড কনস্টেবল ফটিক তার কানের কাছে মুখ নিয়ে চেঁচিয়ে জানান দেয়, “স্যার, আজ বড্ড উপরে উঠে গিয়েছেন স্যার। আপনার মাথাটা যে গ্যাসবেলুনের মতো নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে। এবার একটু নেমে আসুন স্যার।”
প্রাণপতিবাবু তখন নামেন বটে, কিন্তু চারদিককার চুরি, গুন্ডামি, ডাকাতি, খুনজখম, পকেটমারি এসব দেখে ভারী বিরক্ত হন।
আজ সকালের দিকটায় প্রাণপতিবাবু ইনফিনিটি জিনিসটা নিয়ে ভাবছিলেন। ওই ইনফিনিটি বা অসীম ব্যাপারটা কী, তা ভাবতে ভাবতে তাঁর মনপ্রাণ ডানা মেলে একেবারে আকাশে উধাও হয়ে গিয়েছিল। ঠিক এই সময় তিনি হঠাৎ ‘লাশ’ শব্দটা শুনতে পেলেন।
কে যেন বেশ হেঁকেই বলল, “স্যার, একটা লাশ এসেছে।”
‘লাশ’ শব্দটা তিনি জীবনে কখনও শুনেছেন বলে মনে হল না। লাশ! লাশ মানে কী? লাশ কাকে বলে? লাশ দেখতে কেমন?
ফটিক ফের চেঁচাল, “স্যার, একটা লাশ এসেছে।”
ভারী বিরক্ত হয়ে প্রাণপতিবাবু বললেন, “লাশ এসেছে! সেটা তো পুলিশ কেস! এখানে কেন, ওদের থানায় যেতে বলো।”
“আজ্ঞে, এটাই অষ্টপুরের থানা স্যার। আর আপনিই বড়বাবু।”
অনন্ত আকাশের একদম মগডাল থেকে প্রাণপতিবাবু ঝম করে পারিপার্শ্বিকে নেমে এলেন এবং বুঝতে পারলেন, তিনি অষ্টপুর নামে একটা নষ্ট ও ভ্রষ্ট জায়গায় বড় কষ্টে আছেন।
খুব বিস্ময়ের সঙ্গেই প্রশ্ন করলেন, “লাশ! লাশ! কীসের লাশ? কার লাশ?”
ফটিক অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গেই বলল, “আজ্ঞে, মানুষেরই লাশ।”
বাস্তব জগতের সঙ্গে প্রাণপতিবাবুর খটাখটি বহু দিনের। এই বাস্তব জগতে এমন বহু ঘটনা ঘটে, যেগুলোর কোনও অর্থ হয় না, না ঘটলেও চলে যেত, ঘটা উচিত ছিল না। তবু ঘটে। এই যে একটা লাশের কথা তিনি শুনছেন, যদি ঠিক শুনে থাকেন, তা হলে ওই লাশ নিয়ে তাঁকে এখন বিস্তর ঝামেলা পোহাতে হবে।
অত্যন্ত হতাশ হয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “বডিটা কার?”
“নামধাম জানা যায়নি স্যার, তবে গায়ে কয়েদির পোশাক আছে। মনে হয়, সদরের জেলখানা থেকে পালিয়ে এসেছে। একটু আগেই অবনী ঘোষালের পকেট মারতে গিয়ে ধরা পড়ে যায়। তারপর হাটুরে কিল খেয়ে অক্কা পেয়েছে।”
“এটা অত্যন্ত অন্যায়।”
ঘটনাক্রমের ভিতর অনেক অন্যায়ের গন্ধ আছে বলে পরিষ্কার থাকার জন্য ফটিক জিজ্ঞেস করল, “কোনটা অন্যায় স্যার?”
“সদরের জেলখানা থেকে পালিয়ে মরার জন্য অষ্টপুর ছাড়া কি আর জায়গা ছিল না লোকটার?”
“সবাই যদি বুদ্ধিমান আর বিবেচক হত, তা হলে তো কথাই ছিল না স্যার।”
ছোট কনস্টেবল বক্রেশ্বরের ধ্যানজ্ঞান হল হোমিয়োপ্যাথি। অবসর সময়ে বসে ‘সহজ পারিবারিক চিকিৎসা’ বা ‘হোমিয়োপ্যাথি শিক্ষা’ ইত্যাদি বই পড়ে। সর্বদাই ছোট একখানা কাঠের বাক্স থাকে তার কাছে। মানুষ তো বটেই, গোরু-ছাগলকেও সে হোমিয়োপ্যাথি ওষুধ খাওয়ায় বলে শোনা গিয়েছে।
বক্রেশ্বর ঘরে ঢুকে একখানা স্যালুট ঠুকে বলল, “মনে হয়, বেঁচেও যেতে পারে স্যার। নাক্স ভমিকা আর আর্নিকা ঠুসে দিয়েছি। ঘণ্টাখানেক বাদে আরও দুটো ওষুধ দেব। নাড়ি এখনও বসে যায়নি, মাঝে-মাঝে কেঁপে-কেঁপে উঠছে।”
নিজের ভাগ্যের উপর খুব একটা ভরসা নেই প্রাণপতির। ভাগ্য ভাল বা চলনসই হলেও দর্শনশাস্ত্রে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত প্রাণপতির শেষ পর্যন্ত পুলিশের চাকরি জুটত না। আর মুন্ডু ও ধড়ের বিবাদে নিয়ত দ্বিখণ্ডিত হতে হত না তাকে। তবু প্রাণপতি মিনমিন করে বললেন, “দেখো, কী হয়।”
বক্রেশ্বরের ওষুধের গুণেই হোক কিংবা প্রাণপতির বিরূপ ভাগ্য হঠাৎ সদয় হওয়াতেই হোক, ঘণ্টাখানেক পরে লাশটার নাড়ি চলতে শুরু করল, শ্বাসপ্রশ্বাসও চালু হল। শশধর ডাক্তার এসে লোকটির ক্ষতস্থানে মলম আর পুলটিস লাগাতে লাগাতে দুঃখ করে বললেন, “ছ্যাঃ ছ্যাঃ, আজকাল কী সব পকেটমার হয়েছে বলুন তো, ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যায়! হ্যাঁ, পকেটমার ছিল বটে আমাদের আমলের কালু বারুই। ইয়া বুকের ছাতি, ইয়া হাতের গুলি। ফুলবাড়ির দারোগা হেরম্ববাবু তো তাকে গাছে বেঁধে আধবেলা বাঁশপেটা করেছিলেন। তারপর তারই সর্বাঙ্গে ব্যথা। কালু তো হেসেই খুন।”
প্রাণপতিবাবু শশধর ডাক্তারের উপর ভরসা রাখেন না। তার মেয়ের আমাশা শশধর এখনও সারাতে পারেননি। তার ওষুধে কারও কিছু সারে বলেও শোনা যায় না। তবু জিজ্ঞেস করলেন, “অবস্থা কেমন দেখছেন ডাক্তারবাবু?”
“বেঁচে যেতেও পারে। মারা যাওয়াও বিচিত্র নয়। সবই ভগবানের হাত, বুঝলেন তো!”
প্রাণপতি বুঝলেন। বুঝতে তার কোনও অসুবিধেই হল না।
নবীন হামাগুড়ি দিয়ে একটা সুড়ঙ্গ পেরনোর চেষ্টা করছিল। ভারী পিছল সুড়ঙ্গ, তার উপর বেশ চড়াই, কাজটা সহজ নয়। একটু দূরেই অবশ্য সুড়ঙ্গের মুখ দেখা যাচ্ছে। আর পাঁচ-সাতবার হামা টানতে পারলেই পৌঁছে যাবে। আর এখানে পৌঁছে যেতে পারলেই সব সমস্যার সমাধান। নবীন তাই হাঁচোড়-পাঁচোড় করে যত তাড়াতাড়ি