নয়। সকালে বাজার করতে বেরিয়ে জীবনে প্রথম পকেটমারি হল তার এবং শীতলামন্দিরে প্রণাম করার সময় নতুন চপ্পলজোড়া হাপিশ।
বৃত্তান্ত এখানেই শেষ নয়। শ্যালকের নতুন সাইকেলখানা নিয়ে থানায় এজাহার দিতে যাওয়ার সময় পাশের বাড়ির যদুবাবুকে বারান্দায় বসে থাকতে দেখে সাইকেল থেকে নেমে অষ্টপুরের চোরেদের আদ্যশ্রাদ্ধ করছিল অবনী। সাইকেলখানার হ্যান্ডেল তার ডান হাতে শক্ত মুঠিতে ধরা। কথা শেষ করে পিছন ফিরে দেখে, সাইকেল উবে গিয়েছে, তার ডান হাতে হ্যান্ডেলের বদলে একটা মোমবাতি গুঁজে রেখে গিয়েছে কেউ।
শ্বশুরবাড়ির দেশে এসে এরকম আহাম্মক আর হাস্যাস্পদ হয়ে অবনী জ্বলে উঠল। ঠিক করল, এর একটা বিহিত না করলেই নয়। চোরদের উচিত শিক্ষা না দিয়ে সে ছাড়ছে না। সুতরাং গত তিন দিন যাবৎ সে শ’ পাঁচেক করে ডন বৈঠক দিয়েছে, মনের একাগ্রতা বাড়ানোর জন্য ধ্যান, অনুভূতির সূক্ষ্মতা বৃদ্ধির জন্য প্রাণায়াম এবং আহারশুদ্ধির জন্য হবিষ্যি পর্যন্ত করেছে।
আজ সকালে উঠে তার মনে হয়েছে, হা, সে প্রস্তুত। শরীর হালকা লাগছে, বিশ ফুট দূরে একটা পেয়ারা গাছের মগডালে একটা ছোট্ট পিঁপড়েকেও ঠাহর করতে পারল সে। আলসে দিয়ে যে বেড়ালটা হেঁটে গেল, তার পায়ের শব্দ টের পেতে তার বিশেষ অসুবিধে হল না। এমনকী, নাকের ডগায় একটা মশা বসেছিল বলে সেটাকে মারতে যেই হাত তুলেছে, অমনি স্পষ্ট দেখতে পেল, মশাটা হাতজোড় করে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে বলল, “ভুল হয়ে গিয়েছে স্যার, এবারকার মতো ছেড়ে দিন।”
গায়ের জোরের পরীক্ষাতেও সে কম গেল না। একটা ঝুনো নারকোল কিল মেরে ফাটিয়ে দিল, কুয়োর দড়ি দু হাতে টেনে ডিমসুতোর মতো ছিঁড়ে ফেলল, লোহার শাবল তুলে হাঁটুতে রেখে চাড় দিয়ে বেঁকিয়ে ফেলল।
তারপর গরদের পাঞ্জাবি আর ধুতি পরে, মানিব্যাগে হাজার কয়েক টাকা নিয়ে, মা কালীকে প্রণাম করে বাজারে বেরোল। চোখ চারদিকে ঘুরছে, ছ’টা ইন্দ্রিয়ই সজাগ, শব্দ-দৃশ্য-গন্ধ সব টের পাচ্ছে। এবং বাজারের কাছ বরাবর গিয়ে তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় স্পষ্টই জানান দিতে লাগল যে, চোরটা কাছেপিঠেই ঘাপটি মেরে আছে।
চোরটাকে খেলিয়ে তোলার জন্যই সে আজ ফসফস করে টাকা খরচ করল। তারপর চায়ের দোকানে বসে একটু ছোট্ট অভিনয় করতে হল। তার পাঞ্জাবিতে মোটেই কোনও কাক বড়-বাইরে করেনি। তবু সে মানিব্যাগটা বেখেয়ালে বেঞ্চের উপর রেখে পাঞ্জাবি ধুতে টিউবওয়েলে যেতেই চোরটা ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে পড়ল।
নবীন দৌড়ে সবে দিঘিটার দিকে বাঁক নিয়েছে, অমনি কে যেন কাক করে তার ঘাড় ধরে নেংটি ইঁদুরের মতো শূন্যে তুলে ফেলল। তারপর ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলল, “তা হলে তুমিই সেই ওস্তাদ, অ্যাঁ!”
নবীনের মুখে বাক্য নেই। শরীর দুর্বল, খিদে-তেষ্টায় প্রাণ ওষ্ঠাগত।
হ্যাঁচড়াতে-হাচড়াতে তাকে বাজারের চাতালে এনে ফেলল অবনী ঘোষাল। হাঁক মেরে বলল, “এই যে তোমাদের অষ্টপুরের ওস্তাদ চোরকে ধরেছি। এখন এর ব্যবস্থা তোমরাই করো। আমার মানিব্যাগ নিয়ে পালাচ্ছিল।”
অষ্টপুরের জামাই অবনী ঘোষালের হেনস্থার কথা গাঁয়ের সবাই জানত। তার জন্য মরমে মরেও ছিল তারা। শত হলেও গাঁয়ের কুটুম। তার হেনস্থায় অষ্টপুরেরই অপমান। সুতরাং চোখের পলকে
বিশ-পঞ্চাশজন লোক জুটে গেল। কারও হাতে বাঁশ, কারও হাতে লাঠি।
তারপর দে মার! দে মার! খিদের কষ্ট, অভাবের তাড়না থাকলেও জীবনে মারধর বিশেষ খায়নি নবীন। নিরীহ, ভিতু ছেলে সে। ধর্মভয় প্রবল। উপোসি, ক্লান্ত শরীরে হাটুরে মার খাওয়ার ক্ষমতাই ছিল না তার। তাই প্রথম কয়েক ঘা চড়চাপড় আর লাথি-ঘুসি খেয়েই সে অজ্ঞান হয়ে গেল। তারপর আরও অন্তত আধ ঘণ্টা লাঠি আর বাঁশ দিয়ে যে পেটানো হল তাকে, তা আর সে টের পেল না।
মার যখন থামল, তখন নবীনের মুখ আর নাক দিয়ে প্রবল রক্ত গড়াচ্ছে, বাঁ চোখ ফুলে ঢোল, ঠোঁট ফেটে রক্তাক্ত হয়ে আছে। মাথার চুলে রক্ত জমাট বেঁধে আছে।
বটতলার একটু তফাতে একটা কদম গাছের তলায় লুঙ্গি পরা একটা লোক বসে বসে দৃশ্যটা দেখছিল। তার গায়ে একটা পিরান, গালে রুখু দাড়ি, ঝোলা গোঁফ। রোগা ছিপছিপে চেহারার মাঝবয়সি লোকটা দৃশ্যটা দেখে আপনমনেই বিড়বিড় করে বলছিল, “একে আহাম্মক, তার উপর কাঁচা হাত। ওরে বাপু, বিশ-বাইশ বছর বয়সে কি আর কাজে নেমে পড়তে হয়! এ হল শিক্ষার বয়স। হাত পাকতে, বুদ্ধি স্থির হতেই তো কম করে দশটি বছরের ধাক্কা।”
অবনী ঘোষাল একটু তফাতে সঁড়িয়ে বিজয় গর্বে হাসি-হাসি মুখে দৃশ্যটা দেখছিল। ভিড়ের ভিতর থেকে একজন লোক বলে উঠল, “এঃ, এর যে হয়ে গিয়েছে রে।”
আর একজন উবু হয়ে বসে নাড়ি দেখে বলল, “নাড়ি চলছে কি
না বোঝা যাচ্ছে না বাপু।”
ভিড়টা সঙ্গে সঙ্গে পাতলা হয়ে যেতে লাগল।
লুঙ্গি পরা লোকটা এবার উঠে চায়ের দোকান থেকে এক ঘটি জল নিয়ে এসে নবীনের মুখে-চোখে একটু ঝাঁপটা দিয়ে ফের বিড়বিড় করে বলল, “পেটের দায় তো বুঝি রে বাপু, কিন্তু আগুপিছুও ভাববি তো। প্রাণটা গেলে আর মানুষের থাকে কী! দেহখানা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে নেই। বিদ্যের আধার, প্রাণের আধার, ভগবানেরও বাস। দেহ কি ফ্যালনা রে!”
৩. প্রাণপতি খাসনবিশ
এতদিনে সকলেই জেনে গিয়েছে যে, প্রাণপতি খাসনবিশ একজন আলাভোলা মানুষ। তিনি দর্শনশাস্ত্রে এম এ এবং এম ফিল। মুন্ডু এবং ধড়কে যদি আলাদা ভাবে বিচার করা যায়, তা হলে দেখা যাবে, প্রাণপতিবাবুর মুভুটা সর্বদাই নানা রকম দার্শনিক চিন্তায় ডুবে আছে, পৃথিবীটা কি আছে না নেই, সামনের ওই দেওয়ালটা কি সত্যি না মিথ্যে, অস্তিত্ব ব্যাপারটা কি মায়া না মতিভ্রম! আচ্ছা, ওই যে মেটে কলসি করে মেয়েটা জল আনছে, ওই মেটে কলসিটা আসলে কী? মৃৎপাত্র? না, মৃৎপাত্র তো অনেক রকমের হয়। তা হলে কলসি বলতে শুধু মৃৎপাত্র বললে তো হবে না। গোলাকার মৃৎপাত্র? উঁহু, তাতেও পুরো বোঝা যাবে না। জল রাখার জন্য গোলাকার মৃৎপাত্র? উঁহু, ওতেও গণ্ডগোল রয়ে গেল!