জঙ্গলের আড়ালে ঘাপটি মেরে থেকে সে জায়গাটা একটু আঁচ করার চেষ্টা করছিল। গাঁয়ের নাম তার জানা নেই বটে, কিন্তু বেশ একটা লক্ষ্মীশ্ৰী আছে। বেশ পছন্দসই জায়গা।
বুদ্ধি তার কোনওদিনই বিশেষ নেই। তবু সে একটা গাছের তলায় বসে খুব মন দিয়ে ফন্দি আঁটার চেষ্টা করতে লাগল। হঠাৎ তার মনে হল, রাস্তার উলটো দিকে যে পুরনো গির্জাটা আছে, সেটায় বোধ হয় এখন কোনও লোকজন নেই। বড় দরজাটায় কোনও তালাটালাও দেখা যাচ্ছে না। সে উঁকি দিয়ে চারদিকটা একবার দেখে নিয়ে দুই লাফে রাস্তাটা ডিঙিয়ে গির্জার দরজাটা সাবধানে ফাঁক করল। তারপরেই চমকে উঠে দেখতে পেল, একজন বুড়ো মানুষ একটা লম্বা উঁটিতে লাগানো ব্রাশের মতো জিনিস দিয়ে ভিতরের মেঝে ঝাট দিচ্ছে। টপ করে দরজাটা ভেজিয়ে দিল নবীন। আর একটু হলেই ধরা পড়ে যেত।
ফের জঙ্গলের মধ্যে এসে আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগল সে। এভাবে চুপচাপ বসে থাকলে সে যে বাঁচবে না, এটা স্পষ্টই বুঝতে পারছিল নবীন। সাহস করে কিছু একটা করতেই হবে। এমনকী, চুরিও।
জঙ্গলের আড়ালটা বজায় রেখেই সে খানিকটা এগিয়ে গেল। সামনে একটা বিশাল দিঘি, তাতে টলটলে জল। এদিকটায় লোকজনও নেই। নবীন দিঘির ধারে নেমে আঁজলা করে তুলে অনেকটা জল খেয়ে নিল। জলে খানিকটা কাজ হয় বটে, তবে বেশিক্ষণ জল খেয়ে থাকা যাবে না।
নবীন একটু দম নিয়ে সাহস করে জঙ্গল ছেড়ে বাড়িঘরের পিছনবাগে গা ঢাকা দিয়ে গাঁয়ের দোকানপাটের সন্ধানে এগোতে লাগল। যেখানে মেলা লোকের ভিড়, সেখানে মিলেমিশে গেলে হয়তো তার পোশাকটা লোকের তেমন চোখে পড়বে না।
কপালটা তার ভালই। বেশ একটা জমজমাট চত্বরের কাছেপিঠে সহজেই হাজির হয়ে গেল সে। প্রকাশ্যে বেরোতে অবশ্য সাহস হল না। একখানা খেজুর গাছের আবডালে কিছু ঝোঁপঝাড় দেখে সেখানেই গা ঢাকা দিয়ে নজর রাখতে লাগল। সামনেই একটা চাতালে বাজার বসেছে। রাস্তার দু’ধারে বেশ কয়েকটা দোকান। জামাকাপড়, খাবার, স্টেশনারি জিনিস সবই পাওয়া যায়। পয়সা থাকলেই হল। আর নবীনের পয়সাটাই নেই। মাধবগঞ্জের পিসির কাছে তার পাঁচ লাখ টাকা গচ্ছিত আছে বটে, কিন্তু থেকেও নেই। এখন মনে হচ্ছে, ওটা একটা রূপকথার গল্প ছিল।
একজন বেশ ফর্সা, স্বাস্থ্যবান, গরদের পাঞ্জাবি আর ধুতি পরা লোক একটা ঝকঝকে সাইকেলে চেপে এসে চত্বরে নামল।
লোকটার হাবভাব ভারী বেপরোয়া। তালা না লাগিয়েই সাইকেলখানা বটতলার ছায়ায়, স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে বাজার করতে ঢুকে গেল। পয়সা আছে বটে লোকটার। দরদাম না করেই একজোড়া ইলিশ কিনে ফিলল, দু’ কেজি পাঁঠার মাংস, এক কুড়ি কই মাছ, মিষ্টির দোকান থেকে এক হাঁড়ি দই আর দু’ বাক্স মিষ্টি। একটা কুলি গোছের লোকের হাতে বাজারের জিনিসগুলো গছিয়ে রওনা করিয়ে দিয়ে লোকটা চায়ের দোকানে চা খেতে বসল। তারপর চায়ের দাম মেটাতে মানিব্যাগটা যখন বের করেছে, তখনই বোধ হয় বটগাছ থেকে একটা বেরসিক কাক বড়-বাইরে করে দিল লোকটার পাঞ্জাবিতে। লোকটা ভারী বিরক্ত হয়ে একবার উপর দিকে চেয়ে শশব্যস্তে ছুটে গেল কাছের টিউবওয়েলে পাঞ্জাবি ধুতে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, মানিব্যাগটা পড়ে রইল বেঞ্চের উপরেই। আর এমনই কপাল নবীনের যে, সে যেখানে লুকিয়ে আছে, তার মাত্র সাত-আট ফুট দূরেই মানিব্যাগটা। দোকানে খদ্দের নেই। দোকানিও অন্য কাজে ব্যস্ত। নবীনের মনে হল, এ একেবারে ভগবানের দান। এ সুযোগ ছাড়া মহাপাপ।
আর যাই হোক, নবীনের একটা গুণ স্বীকার করতেই হয়। সে হরিণের মতো দৌড়তে পারে। বুকটা যদিও কাপছিল, জীবনে কখনও চুরিটুরি করেনি বলে মনটাও আড় হয়ে আছে। তবু সব দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে নবীন দুই লক্ষে অকুস্থলে পৌঁছে মানিব্যাগটা খপ করে তুলে নিয়েই আবার হরিণপায়ে ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। মানিব্যাগটা সঙ্গে রাখা বোকামি৷ সে তাড়াতাড়ি টাকাগুলো বের করে নিয়ে ব্যাগটা ফেলে দে দৌড়।
কথা হচ্ছে, সব ঘটনার আগেও ঘটনা থাকে, পরেও ঘটনা থাকে। এই অবনী ঘোষালের কথাই বলছিলাম আর কী। অবনী ঘোষাল অতিশয় হুশিয়ার লোক। জীবনে তার কখনও পকেটমারি হয়নি, বাড়িতে চোর ঢোকেনি, মন্দিরে জুতো চুরি যায়নি, কেউ তাকে কখনও ঠকাতেও পারেনি। অবনী সর্বদা সজাগ, চারদিকে চোখ, ঘুম খুব পাতলা, হিসেব-নিকেশের মাথা চমৎকার। দ্বিরাগমনে অষ্টপুরের শ্বশুরবাড়িতে এসেছে অবনী। রাত্রিবেলা খাওয়ার সময় অবনীর শ্বশুর শ্রীনিবাস আচার্যি কথায় কথায় বললেন, “বাবাজীবন, অষ্টপুর বড় চোর-ঘঁচোড়ের জায়গা, রাস্তাঘাটে একটু খেয়াল রেখে চোলো৷ রাত্তিরে সজাগ থেকো।”
শুনে অবনী প্রায় অট্টহাসি হাসে আর কী। গম্ভীর ভাবে বলেছিল, “সেইসব চোর-বাটপাড় এখনও মায়ের পেটে।”
প্রথম রাত্তিরেই আড়াই হাজার টাকাসমেত তার মানিব্যাগটা বালিশের তলা থেকে হাওয়া, কবজি থেকে হাতঘড়ি আর ডান হাতের অনামিকা থেকে পোখরাজের আংটি উধাও, খাটের নীচ থেকে সুটকেস নিরুদ্দেশ, হ্যাঙারে ঝোলানো আন্দির পাঞ্জাবি থেকে সোনার বোতাম লোপাট।
কাণ্ড দেখে অবনী রাগে গরগর করতে লাগল, আক্রোশে ফুসতে লাগল, প্রতিশোধস্পৃহায় সঁত কড়মড় করতে লাগল। অষ্টপুরের চোরেদের সে পারলে চিবিয়ে খায়। তবু এখানেই শেষ