আবার এক ঝড়-বৃষ্টির রাতে পুলিশ তাকে ভ্যানে করে নিয়ে গিয়ে একটা জঙ্গলের ধারে নামিয়ে দিল। বলল, “পালা বাপু। প্রাণপণে দৌড়ো। একটু পরে আমরা কিন্তু পিছন থেকে গুলি চালাব। লেগে গেলে দোষ নেই কিন্তু।”
এমন দৌড় নবীন জীবনে দেয়নি। অন্ধকারে গাছপালা ভেদ করে সে কী ছুট! পিছনে চার-পাঁচবার গুলির শব্দও হয়েছিল ঠিকই। ঝড়, বাদলা, অন্ধকার আর জঙ্গল সব মিলিয়ে সে এক অশৈলী অবস্থা। নবীন কতবার যে আছড়ে পড়ল, আর গাছে-গাছে ধাক্কা খেল, তার হিসেব নেই। কিন্তু প্রাণের ভয়ের চেয়ে বড় ভয় আর কী আছে! জঙ্গলটা শেষ হওয়ার মুখে একটা খালের জলে গিয়ে পড়ল নবীন। সাঁতরে খাল পেরিয়ে একটা ফাঁকা ঘাট। তারপর ফের জঙ্গল। নিশুত রাতে জলে ঝুম্বুস ভিজে সে যখন কাঁপছে, পা আর চলছে না, তখন একটা বাড়ির হদিশ পাওয়া গেল। কার বাড়ি, ঢুকলে চোর বলে ঠ্যাঙাবে কি না, সেইসব ভাবার মতো মনের অবস্থা নয়। সে কোনওরকমে বারান্দায় উঠে সামনের দরজায় একটা ধাক্কা দিল। কিন্তু কপাটহীন দরজায় ধাক্কাটা লাগল না, বরং নবীন হড়াস করে ঘরের ভিতরকার মেঝের উপর পড়ে গেল। কোনওরকমে উঠে একটা দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে হাঁটু তুলে তাতে মুখ গুঁজে হাঁফাতে লাগল। ক্লান্তিতে শরীর এমন ভেঙে এল যে, ভেজা গায়েই। নিঃসাড়ে ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু ঘুমের মধ্যেও সে টের পাচ্ছিল, এ বাড়ির লোকেরা তার এই আকস্মিক আগমনে মোটেই খুশি হয়নি।
কে যেন বলল, “এটা আবার কে রে?”
কেউ যেন জবাব দিল, “গায়ে তো কয়েদির পোশাক দেখছি।”
একজন বুড়ো মানুষের গলা শোনা গেল, “ও হল ফাঁসির আসামি। নবীন।”
ধরাই পড়ে গেল কি না, সেটা বুঝতে পারল না নবীন। ধরা পড়লে আবার হয়তো হাজতেই নিয়ে যাবে তাকে। ফাঁসিও হতে পারে। এত খেটেখুটেও লাভ হল না তেমন। তবে শরীরটা ক্লান্তিতে বস্তার মতো ভারী হয়ে আছে বলে ভয়ডরও তেমন কাজ করল না।
সে কাত হয়ে মেঝেয় শুয়ে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ল। ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই নবীন ভারী বুরবক হয়ে গেল। সে একটা পোড়ো বাড়ির ভাঙাচোরা ঘরে ধুলোময়লার মধ্যে পড়ে আছে। চারদিকে উঁই হয়ে আছে আবর্জনা। এ বাড়িতে বহুকাল মানুষের বাস নেই। তবে কি ঘুমের মধ্যে সে ভুলভাল কথাবার্তা শুনেছে? তাই হবে। স্বপ্নই দেখে থাকবে হয়তো। এটা কোন জায়গা, তা তার জানা নেই। কাছেপিঠে লোকালয় আছে কি না, কে জানে। সবচেয়ে বড় কথা, খিদে চাগাড় দিচ্ছে, আর পকেটে পয়সা নেই।
২. আড়ে-দিঘে অষ্টপুর
আড়ে-দিঘে অষ্টপুর খুব একটা বড় জায়গা নয়, বিখ্যাতও নয় তেমন। তা অষ্টপুরে দ্রষ্টব্য জায়গা কিছু কম নেই। বিন্ধ্যেশ্বরীর মন্দিরের লাগোয়া দ্বাদশ শিবের থান আছে। পুব দিকে উজিয়ে গেলে দয়াল সরোবর। এত বড় দিঘি দশটা গাঁ ঘুরে পাওয়া যাবে না। দিঘি পেরোলে বাঁ হাতে নীলকুঠির মাঠ, তারপর জঙ্গলের মধ্যে ফস্টারসাহেবের ভুতুড়ে বাড়ি। ওদিকটায় না যাওয়াই ভাল। সাপখোপ আছে। আর এখানকার ভূত খুব বিখ্যাত। ডান ধারে সিটুলসাহেবের গির্জা। এখন আর এই অঞ্চলে খ্রিস্টান কেউ নেই বটে, কিন্তু হরেন চাটুজ্যের মা রোজ সন্ধেবেলা এসে গির্জায় মোমবাতি জ্বেলে দিয়ে যিশুবাবাকে প্রণাম করে যান। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলেন, “আহা, যিশুবাবা বড় কষ্ট পেয়েছিল গো! ভাবলে আজও আমার চোখে জল আসে যে!”
গির্জা পেরিয়ে ডানহাতি রাস্তা ধরে সোজা এগোলে মহারাজ বীরেন্দ্রনারায়ণের ভাঙা প্রাসাদটা ডান হাতে পড়বে। রাজবংশের কেউ না থাকলেও ফটকের পাশে একটা খুপরি ঘরে বুড়ো ফাগুলাল আজও আছে। রাজবাড়ির পরেই মোস্তাফার হাট। এ হাটের খুব নামডাক। প্রতি মঙ্গলবারে বিশাল হাট বসে যায়। মোস্তাফার হাটের ধারেই মন্তেশ্বরীর খাল। খালধার দিয়ে ডানহাতি ঘুরে একটু এগোলেই থানা। থানা পেরিয়ে চণ্ডীমণ্ডপ, তারপর বিখ্যাত বটতলার চত্বর, যেখানে দোকানপাট আছে, চা আর নানখাটাই বিস্কুট পাওয়া যায়। বটতলা পেরিয়ে মসজিদ। ফের ডান দিকে ফিরলে দুর্গামণ্ডপ, প্রগতি ক্লাব, স্কুল, খেলার মাঠ। সুতরাং অষ্টপুর খুব একটা ফ্যালনা জায়গা নয়।
কয়েকদিন বর্ষাবাদলার পর আজ অষ্টপুরে রাঙা রোদ উঠেছে। আবহাওয়া অতি মনোরম। গাছে-গাছে পাখি ডাকছে। তার সঙ্গে গোরুর হাম্বা, কুকুরের ঘেউ ঘেউ, বেড়ালের ম্যাও সবই যথোচিত শোনা যাচ্ছে। অষ্টপুরের মানুষজন অনেকেই বিষয়কর্মে বেরিয়ে পড়েছেন, কেউ কেউ দাঁতন করছেন বা ব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজছেন, কেউ বা পুজো-আহ্নিকে বসেছেন, কেউ বাজারে গিয়ে সবজি বা মাছ কিনছেন, বটতলায় চায়ের দোকানে বেশ জটলা হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে অষ্টপুরের জীবনযাত্রা বেশ স্বাভাবিকই বলা যায়।
জঙ্গল থেকে প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসতে সাহস পাচ্ছিল না নবীন। রাতের অন্ধকারে জঙ্গলে পড়ে গিয়ে আর গাছে ধাক্কা খেয়ে তার মুখ, কপাল, হাত সব ক্ষতবিক্ষত। রক্ত জমাট বেঁধে আছে। কালশিটে পড়েছে। তার গায়ে এখনও কয়েদির পোশাক। লোকে লহমায় ধরে ফেলবে যে, সে জেল থেকে পালিয়ে এসেছে। লোকালয়ে যেতে হলে তার একটা চলনসই পোশাক চাই। তারপর প্রাণে বাঁচতে দরকার একটু দানাপানির। নবীন জীবনে কখনও চুরিটুরি করেনি, ভিক্ষে করার অভ্যেসও নেই। কী করবে, তা সে ভেবে পাচ্ছিল না।