বিশু গায়েন বলল, “লাশটাকে পল্টু পাকড়াশির লাশ বলে চালিয়ে দিতে পারলেই কেল্লা ফতে।”
ভুবন মণ্ডল মাথা নেড়ে বলল, “পল্টুর কোমরে পিস্তল আছে, আমি নিজের চোখে দেখেছি। কুড়ুল নিয়ে যে হামলা করব, তাতে লাভ হওয়ার নয়। গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেবে।”
পিস্তলটা হাতে নিয়ে গির্জার দিকে এগোতে এগোতে প্রাণপতি বললেন, “ভোর হতে আর দেরি নেই। ওরা কি আর এতক্ষণ গির্জার ভিতর বসে আছে! পিছনের কোনও চোরা দরজা দিয়ে পালিয়ে গিয়েছে নিশ্চয়ই।”
গির্জার দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। প্রাণপতি দরজায় ঘা দিয়ে বললেন, “দরজা খোলো।”
দরজা অবশ্য খুলল না। প্রাণপতি বারবার ঘা দিতে লাগলেন।
ভোরের পাখিরা ডাকছে। আকাশ পরিষ্কার হয়ে আসছে। আলো ফুটে উঠল একটু একটু। আর এই সময় বড়, কালো একটা পুলিশ ভ্যান এসে দাঁড়াল গির্জার সামনে। ভ্যান থেকে লাফ দিয়ে নেমে ফটিক চেঁচিয়ে উঠল, “সদর থেকে ফোর্স এসে গিয়েছে স্যার!”
দশ-বারোজন বন্দুকধারী সেপাই নেমে প্রাণপতিকে স্যালুট ঠুকে বলল, “কী করতে হবে স্যার।”
চিন্তিত প্রাণপতি বললেন, “গির্জার দরজাটা ভাঙা হোক, এটা আমি চাই না। কনফ্রন্টেশনও নয়। কারণ, আমার মেয়েটা ওদের হেফাজতে রয়েছে। আপনারা বরং গির্জাটা ঘিরে থাকুন।”
তাই হল।
সূর্যের প্রথম রশ্মি গির্জার মাথার উপরকার ক্রসটাকে ছুঁয়ে ফেলল। গির্জার সামনের দরজাটা খুলে গেল আস্তে আস্তে। ক্লান্ত, বিপর্যস্ত, বিভ্রান্ত তিনজন লোক মড়ার মতো চোখ চেয়ে হাত উপরে তুলে বেরিয়ে এল। পল্টু ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, “গুলি চালাবেন না। আমি সারেন্ডার করছি।”
তাদের ভ্যানে তোলার পর নবীন টলতে টলতে বেরিয়ে এসে মাথায় দু হাত চেপে সিঁড়িতে বসে পড়ল। বলল, “ভাববেন না বড়বাবু, আমার তেমন কিছু হয়নি।”
“কিন্তু আমার মেয়েটা!”
“বাবা! এই তো আমি!” বলে ফুটফুটে মধুছন্দা দরজায় এসে দাঁড়াল। তার হাতে একটা লাল বল।
প্রাণপতি স্মিত হাসলেন। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “ওরা তোকে মারধর করেনি তো?”
“না তো! আমি তো সারারাত একটা ছোট্ট ঘরে সুন্দর একটা বিছানায় ঘুমিয়েছিলাম। ওরা কারা বাবা?”
“ওদের কথা তোমার মনে রাখার দরকার নেই।”
.
নবীন দাস ছাড়া পেয়ে মাধবগঞ্জে ফিরে গিয়েছে। যাওয়ার সময় বলে গিয়েছে, “নগেন পাকড়াশির ওই পাপের টাকার দরকার নেই আমার। চার বিঘে জমি আছে, চাষবাস করলে আমার চলে যাবে।”
কিন্তু প্রাণপতির অনেক হিসেবই মিলছে না। আসামি তিনজনই বলেছে যে, গির্জার মধ্যে সারারাত তারা প্রাণপতির মেয়েকে ধাওয়া করেও ধরতে পারেনি। মেয়েটা তাদের হয়রান করে, বেদম করে দিয়েছিল। প্রাণপতি জানেন, কথাটা সত্যি নয়। মধুছন্দা রাত্রে কোথাও একটা বিছানায় ঘুমিয়েছিল। তা হলে সেই মেয়েটা আসলে কে? প্রশ্ন আরও আছে। তার যে মাথায় নানারকম উদ্ভট চিন্তার উদয় হত, সেগুলো উধাও হল কেন? এসব ভেবে মাঝে-মাঝে তার দীর্ঘশ্বাস পড়ে।
.
কয়েকদিন পরে সন্ধেবেলা মৃদুভাষিণী দেবী টুকটুক করে গিয়ে গির্জার তালা খুলছেন, পাশেই দেখলেন, প্রাণপতি দাঁড়িয়ে।
“ও বাবা! প্রাণপতি যে!”
“আপনার যিশুর কাছে আমার জন্য একটু প্রার্থনা করবেন মাসিমা?”
“কী প্রার্থনা বাবা?”
“আমার মাথায় আগে নানারকম সুন্দর সুন্দর চিন্তা আসত, তাতে বেশ আরামে থাকতাম। সেই চিন্তাগুলো সব হারিয়ে গিয়েছে। আপনার যিশুবাবাকে বলুন, আমার চিন্তাগুলো যেন ফিরে আসে।”
“সে আর বেশি কথা কী! তা তুমিই কেন যিশুবাবাকে বলো।”
“আজ্ঞে, ভারী লজ্জা করে যে!”
“ও মা, যিশুকে লজ্জা কীসের?”
“আমি যে নাস্তিক!”