টর্চটা নিভিয়ে তিনি চুপচাপ অন্ধকার গির্জাটার দিকে চেয়ে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। কোনও শব্দ নেই। ঘটনা নেই।
কিন্তু আবহাওয়ায় তিনি একটা বিপদ-সংকেত পাচ্ছেন। ঘটনার গতি ও প্রকৃতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে আজ রাতেই হয়তো কিছু একটা ঘটবে। কী ঘটবে, সেটাই বুঝতে পারছেন না তিনি।
কাছাকাছি কোনও লোক এসে দাঁড়ালে তার শরীরের তাপ হোক বা গন্ধ হোক, কিছু একটা টের পাওয়া যায়, সে যত নিঃশব্দেই আসুক না কেন। প্রাণপতিও টের পেলেন। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার বলে কিছু দেখার উপায় নেই। টর্চটা জ্বালাবেন কি না বুঝতে পারছেন না। লোকটা শক্ত না মিত্র, তা জানেন না। কিন্তু তার ঘাড় শক্ত হয়ে গেল এবং শরীরের রোঁয়া দাঁড়িয়ে যেতে লাগল। নির্ভুল টের পাচ্ছেন, তার পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে।
স্বভাবসিদ্ধ আত্মরক্ষার তাগিদেই কোমরের পিস্তলটার দিকে হাত বাড়িয়েও হাতটা সরিয়ে নিলেন। কাজটা বোকামি হবে। পিস্তল বের করার আগেই লোকটা যা করার করে ফেলবে। তাই তিনি আচমকা নিচু হয়ে দ্রুত মাটিতে ঝাঁপ খেয়ে শুয়ে পড়ার চেষ্টা করলেন।
কিন্তু ডান্ডাটা এড়াতে পারলেন না। মাথার ডান ধারে একটা কঠিন আঘাত লাগতেই চোখে অন্ধকার দেখে লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে।
.
তাঁর পড়ে থাকা শরীরটা ডিঙিয়েই তিনজন লোক আর-একটা লোককে টানতে টানতে ছ্যাচড়াতে ছ্যাচড়াতে গির্জার দিকে নিয়ে চলল।
গির্জার দরজা খুলে চারদিকে একটা জোরালো টর্চ ফেলে একজন বলল, “মেয়েটা কোথায়?”
আর-একজন জবাব দিল, “এখানেই আছে। আমি নিজে মেয়েটাকে ভিতরে ঢুকিয়ে তালা দিয়ে গিয়েছি। চাবি আমার কাছে।”
“মেয়েটা কোথায় খুঁজে দেখ। দারোগাটা কিছু একটা সন্দেহ করে এখানে এসেছিল, কাজেই আমাদের চটপট কাজ শেষ করে পালাতে হবে।”
যে লোকটাকে হেঁচড়ে আনা হয়েছে, সে মেঝের উপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে।
দ্বিতীয় লোকটা বলল, “সে তো বুঝলুম, কিন্তু এতটা পথ আসতে হয়েছে, একটু জিরোতে দাও।”
“জিরোতে গেলে ধরা পড়ার ভয় আছে। আচ্ছা, পাঁচ মিনিট। কিন্তু তার আগে মেয়েটাকে খুঁজে দেখ।”
“বাচ্চা মেয়ে, কোথাও গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছে বোধ হয়। পরে দেখা যাবে।”
পাঁচ মিনিটও কাটেনি। হঠাৎ একটা শব্দে তিনজনেরই চটকা ভাঙল এবং তারা অবাক হয়ে দেখল, যিশুর মূর্তির সামনে বেদির উপর মস্ত বড় একটা সাদা মোম কে যেন জ্বালিয়ে দিয়েছে। সেই আলোয় দেখা যাচ্ছে, দু ধারে ভাঙা বেঞ্চের স্থূপ আর মাঝখানে চওড়া একটা প্যাসেজ। সেই প্যাসেজটায় বেদির দিক থেকে একটা লাল রঙের বল গড়িয়ে আসছে। তার পিছনেই খিলখিল করে হাসতে হাসতে বঁকড়া চুলওলা একটা মেয়ে দৌড়ে আসছে।
চণ্ডী বলল, “ওই তো দারোগার মেয়েটা!” ভ্রু কুঁচকে পল্টু পাকড়াশি বলল, “কিন্তু মোমটা জ্বালাল কে?”
“তা তো জানি না।”
“ভাল করে দেখ। গির্জায় লোক ঢুকেছে নিশ্চয়ই।”
তিনজনই লাফিয়ে উঠল। টর্চ নিয়ে চারদিকে খুঁজে দেখতে লাগল। কোথাও কাউকে পাওয়া গেল না।
চণ্ডী অবাক হয়ে বলে, “ভুতুড়ে কাণ্ড নাকি রে বাবা!”
“মেয়েটাকে ধরে জিজ্ঞেস কর। ও নিশ্চয়ই জানে।”
কিন্তু মেয়েটা তাদের দিকে ভ্রুক্ষেপও না করে সারা গির্জা বলের পিছনে ছুটছে আর হাসছে। কখনও হাততালি দিয়ে উঠছে।
চণ্ডী তার পিছনে ছুটতে ছুটতে বলতে লাগল, “ও খুকি, শোনো, শোনো। মোমটা কি তুমি জ্বালিয়েছ?”
মেয়েটা জবাব দিচ্ছে না। সামনে বলটা কেবলই গড়িয়ে যাচ্ছে। আপনা থেকেই ডাইনে গড়িয়ে যাচ্ছে, আবার বাঁয়ে। মেয়েটার সঙ্গে ছুটে পেরে উঠছে না হোঁতকা চণ্ডী। হাঁপসানো গলায় বলল, “ওরে পল্টু, ওকে সামনে থেকে ধরে থামা।”
মেয়েটা প্যাসেজে ঢুকতেই পথ আগলে দাঁড়াল পল্টু। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, মেয়েটা দিব্যি তার হাত এড়িয়ে লহমায় পেরিয়ে গেল তাকে। বগা মেয়েটাকে দু হাতে জাপটে ধরার চেষ্টা করতে গেল। কীভাবে যে হাতের ফাঁক দিয়ে গলে গেল, তা বোঝাই গেল না। মেয়েটা যেন তাদের দেখতেই পাচ্ছে না, এমন ভাবে ছুটছে বলটার পিছনে। আর বলটাও দিব্যি গড়িয়ে যাচ্ছে আপনা থেকেই।
চণ্ডী বলল, “কী ব্যাপার বল তো, কী হচ্ছে এসব?”
পল্টু দাঁত কড়মড় করে বলল, “মেয়েটা বহুত চালাক। ধর ওকে, নয়তো বিপদ।”
সুতরাং, তিনজনই তিন দিক থেকে মেয়েটাকে রোখার চেষ্টা করতে লাগল। দৌড়ে, ঝাঁপিয়ে, ল্যাং মেরে কোনও ভাবেই তারা কিছু করে উঠতে পারছিল না। মেয়েটা খিলখিলিয়ে হাসছে আর মনের আনন্দে ছুটে বেড়াচ্ছে। কখনও যিশুবাবার বেদিতে উঠে যাচ্ছে, কখনও ভাঙা বেঞ্চের তূপের উপর দিয়ে লাফিয়ে, ডিঙিয়ে যাচ্ছে, হাঁফিয়ে পড়ছে না, ক্লান্ত হচ্ছে না।
কিন্তু মেয়েটার পিছনে ধাওয়া করতে করতে ক্রমে ক্রমে তিনজন হফিয়ে পড়ছিল। একসময় কোমরে হাত দিয়ে চণ্ডীচরণ দাঁড়িয়ে পড়ল। বগা একটা ভাঙা বেঞ্চে পা আটকে দড়াম করে পড়ল। পল্টু বুক চেপে বসে পড়ল হঠাৎ।
.
প্রাণপতিকে দু’জন লোক দু’ দিক থেকে ধরে তুলে বসাল।
“কেমন আছেন বড়বাবু?”
মাথাটা এখনও টনটন করছে, কিন্তু প্রাণপতি বুঝতে পারছেন, ব্যথাটা অসহ্য নয়। তিনি নিজেই উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “ঠিক আছি। কিন্তু সেই লোকগুলো কোথায় গেল?”
ভুবন মণ্ডল বলল, “ওই গির্জায় ঢুকেছে। মনে হয়, এতক্ষণে নবীন দাসকে মেরে ফেলেছে।”