কে বা কারা তাঁর ফুটফুটে মেয়েটাকে চুরি করে নিয়ে গিয়েছে। অন্য সময় বা আগের প্রাণপতি হলে তিনি শয্যা নিয়ে ফেলতেন, কান্নাকাটি করতেন এবং পুলিশের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবতেন। কিন্তু নতুন প্রাণপতি বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। মেয়ের স্কুলের দিদিমণিদের জেরা করলেন, মধুছন্দার বন্ধুদের কাছেও খোঁজ নিলেন।
জানা গেল, ছুটির পর একজন সেপাইয়ের পোশাক পরা তোক এসে মধুছন্দাকে বলে, “চলো খুকি, তোমার বাবা তোমাকে নিয়ে যেতে পাঠিয়েছেন।”
“তুমি কে?”
“আমার নাম তপন দাস। এ থানায় নতুন এসেছি।”
“কিন্তু আমি তো রোজ একা-একাই বাড়িতে ফিরি। আজ তোমার সঙ্গে যাব কেন?”
“বড়বাবু যে নতুন মোটরবাইক কিনেছেন। সেটাতে চড়িয়ে তোমাকে থানা থেকে বাড়ি নিয়ে যাবেন বলে আমাকে পাঠালেন।”
মধুছন্দা খুব অবাক হয়েছিল, খুশিও। বন্ধুদের কাছে বিদায় নিয়ে তপন দাসের সঙ্গে সে চলে যায়।
প্রাণপতি খবর নিয়ে জানলেন, তপন দাসের চেহারা বেশ গাট্টাগোট্টা, গোঁফ আছে, মাথায় ঘন চুল, হাতে লোহার বালা।
গাঁয়ের লোকরাও কেউ কেউ জানাল যে, তারা খুকিকে একজন সেপাইয়ের সঙ্গে রথতলার দিকে যেতে দেখেছে। কিন্তু কিছু সন্দেহ করেনি।
ঘণ্টা দুয়েক ধরে সার্চ পার্টি সারা গা খুঁজে দেখল। কোথাও মেয়েটাকে পাওয়া গেল না। প্রাণপতি সারাদিন নিজেও ঘুরে ঘুরে নানা জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। চিরকুটটাকেও ভাল করে পরীক্ষা করলেন। মেয়ে চুরি যাওয়া নিয়ে যতটা না ভাবলেন, তার চেয়ে বেশি ভাবলেন ওই লম্বা টেকো, কটা চোখের লোকটাকে নিয়ে। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, ওই লোকটার সঙ্গে ঘটনার যোগ আছে।
দুপুরবেলা উদ্ধবকে ডেকে পাঠালেন তিনি। উদ্ধব কাঁপতে কাঁপতে এল। প্রাণপতি বললেন, “উদ্ধব, সেই ঢ্যাঙা লোকটাকে তুমি চেনো?”
মাথা নেড়ে উদ্ধব বলে, “না হুজুর, ঠিক চিনি না।”
“কিন্তু সকালে তোমার কথা শুনে তো তা মনে হল না।”
“চেনা বলতে যা বোঝায়, তা নয় বড়বাবু।”
“তা হলে?”
“আমি রাতবিরেতে মাঝে-মাঝে এখানে-ওখানে শুয়ে থাকি। ঘরে শুলে আমার কেমন দম আটকে আসে। মাঝে-মাঝে শীতলসাহেবের ভাঙা গির্জার দরজার সামনের জায়গাটায়ও শুই। রোজ সকালে হুজুর, গির্জার ভিতরে ঝটপাটের শব্দ হয়। গির্জায় ইঁদুর, আরশোলা ছাড়া আর কিছু তো থাকার কথা নয়। তাই একদিন জানলার ভাঙা শার্শি দিয়ে উঁকি মেরেছিলুম।”
“কী দেখলে?”
“আজ্ঞে, ওই মানুষটাকে। খুব লম্বা, মাথায় টাক, কটা চোখ, গায়ে জোব্বা মতো। ডান্ডি লাগানো বুরুশ দিয়ে ঘর ঝাটাচ্ছেন।”
“এসব তো ভুতুড়ে গল্প, বিশ্বাসযোগ্যই নয়।”
“আজ্ঞে হুজুর, আমার চোখের বা মনের ভুলও হতে পারে।”
“ধরলাম, ওরকম একজন মানুষ বা ভূত আছে। কিন্তু সে হঠাৎ কাল সকালে আমার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী দেখছিল?”
“তা জানি না হুজুর। কিন্তু উনি আপনার মেয়েকে চুরি করার মতো মানুষ নন বড়বাবু। উনি ভাল লোক।”
প্রায় একই কথা শোনা গেল মৃদুভাষিণীর কাছেও। বললেন, “বাবা প্রাণপতি, তোমার খুকি যেখানেই থাক, ভালই থাকবে। কিন্তু ওকে ছেলেধরা বলে ভেবো না। যিশুবাবার সেবা করে তো, ওরা ওরকম নয়।”
“আপনারা কি আমাকে পাগল করে দেবেন মাসিমা! গির্জায় ওরকম একটা লোক এল কী করে? শেষ অবধি ভূতে বিশ্বাস করতে বলছেন?”
“অত সব জানি না বাবা। তোমার মাথা এখন গরম। মাথাটা ঠান্ডা হলে ভেবো৷”
“গির্জার আনাচ-কানাচ দেখা হয়েছে। সেখানে কেউ থাকে না, কেউ নেইও।”
“ওভাবে খুঁজলে কি পাওয়া যায়, বাবা?”
“তবে কীভাবে খুঁজব?”
“দোর ধরে পড়ে থাকলে হয়তো হয়। কিন্তু সে তুমি পারবে না।”
মেয়ের জন্য উদ্বেগে প্রাণপতির স্ত্রী বিজয়া সারাদিন বারকয়েক অজ্ঞান হয়েছেন, খাননি কিছু, প্রবল কান্নাকাটি করছেন। তবু মনের এই অবস্থায়ও তিনি তাঁর আলাভোলা স্বামীর পরিবর্তনটা লক্ষ করে একবার বললেন, “আচ্ছা, তোমাকে একদম অন্যরকম লাগছে কেন বলো তো!”
প্রাণপতি ভ্রু তুলে বললেন, “কীরকম?”
“কী জানি, বুঝতে পারছি না। কিন্তু যেন অন্য মানুষ। একদম অন্য মানুষ।”
প্রাণপতি এটা বুঝতে পারছিলেন যে, চিঠিতে লেখা শর্ত না মানলে তার মেয়েটাকে হয়তো গুন্ডারা মেরে ফেলবে। শর্ত না মেনে সুতরাং উপায় নেই। কিন্তু তিনি এটা বুঝতে পারছেন না যে, আসামিকে এভাবে ছাড়িয়ে নিয়ে কী লাভ? কারণ, হুলিয়া জারি আছে, কাল সকালেই সদর থেকে ফোর্স আসবে এবং ওদের পালানো মুশকিল হবে। তা হলে কি ছেড়ে দিতে বলার অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে?
রাত্রিবেলা তিনি যখন নবীনকে ছেড়ে দেবেন বলে স্থির করলেন, তখন ফটিক বলল, “কাজটা কি ঠিক হবে স্যার? আমাদের চাকরি নিয়ে না টানাটানি পড়ে যায়!”
“ছেড়ে দেওয়ার জন্য চাকরি গেলে আমার যাবে। তোমাদের দোষ হবে না, ভয় নেই।”
ফটিক একটু গোঁজ হয়ে রইল।
রাত বারোটায় নবীনকে লকআপ থেকে ছেড়ে দিলেন তিনি। নবীন বেরিয়ে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন।
তারপর বাইরের অন্ধকারে বেরিয়ে এলেন। সেপাইদের মধ্যে ফটিক আর বক্রেশ্বর জিজ্ঞেস করল, “আমরা সঙ্গে যাব স্যার?”
“না, আজ আমাকে একাই যেতে হবে।”
কাজটা ঠিক হল কি না, তা প্রাণপতি বুঝতে পারছিলেন না।
নিশুতি রাতে তিনি একা হাঁটতে হাঁটতে গির্জাটার সামনে এসে দাঁড়ালেন। টর্চ জ্বেলে পুরনো নোনাধরা ভগ্নপ্রায় গির্জাটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। এই গির্জার কি কোনও মহিমা থাকা সম্ভব? তিনি ভূত বা ভগবানে বিশ্বাসী নন। কিন্তু উদ্ধব আর মৃদুভাষিণী যা বলছেন, তা ভুতুড়ে ব্যাপার। নয় তো কোনও একটা লোক খ্রিস্টান যাজকের মতো সেজে ওদের ঘোল ঘাওয়াচ্ছে। দ্বিতীয়টাই সত্যি বলে মনে হয়।