“তা দূর আছে।”
“মতলব কী?”
“একজনের খোঁজ করতে আসা। তার নাম পল্টু পাকড়াশি।”
“ও বাবা! সে তো শাহেনশা লোক! দেখা পেলে?”
মাথা নেড়ে ভুবন বলে, “না। থানায় যে আটক আছে, সে পল্টু নয়। পল্টু কাছেপিঠে থাকলে পাপের গন্ধ পাওয়া যায়।”
“গন্ধটা কি পাচ্ছ?”
“মনে হয় পাচ্ছি।”
“তা হলে চলো, কাছেই আমার কুঁড়ে। পান্তা চলে তো?”
“পান্তা খেয়েই তো এত বড়টি হলুম।”
“তা হলে চলো।”
.
বিশু গায়েন নিজের চোখকে বিশ্বাস করবে কি না ভেবে পাচ্ছিল না। পাকা খবর পেয়েই এসেছে যে, পল্টু পাকড়াশি অষ্টপুর থানায় ধরা পড়ে আটক রয়েছে। সদর থেকে পুলিশ ফোর্স আসছে তাকে নিয়ে যেতে। তবু সন্দেহের শেষ রাখতে নেই বলে, সে অষ্টপুরে এসে তার খাতক মহাদেব সরকারের গদিতে উঠেছে।
সব শুনে মহাদেব বলল, “তুমি নিশ্চিন্ত থাকো, তোমার জামাইয়েরও খুনি ধরা পড়েছে, ফাঁসিতে সে ঝুলবেই। আমাদের চোখের সামনেই তো ঘটনাটা ঘটল। অবনী ঘোষালের মানিব্যাগ চুরি করে ধরা পড়ল, তারপর সে কী হাটুরে মার বাবা! মরেই যাওয়ার কথা। কিন্তু মরতে মরতেও জোর বেঁচে গিয়েছে।”
বিশু গায়েনের ধন্ধটা এখানেই। পল্টু পাকড়াশিকে সে ভালই চেনে। মানিব্যাগ চুরি করার মতো ছোটখাটো কাজ করার লোক সে নয়। দরকার পড়লে গলায় ছুরি দিয়ে ছিনতাই করবে, আর হাটুরে মার খাওয়ার আগে অন্তত আট-দশজনকে ঘায়েল না করে ছাড়বে না। তাই তার অঙ্কটা মিলছে না। মনটা খুঁতখুঁত করছে। সুতরাং মহাদেবের সঙ্গে সে একদিন থানার লকআপে আসামিকে দেখতে গিয়েছিল। আর দেখে তার চক্ষুস্থির! নবীন দাসকে সে ভালই চেনে। নবীনের বাবা মাধবগঞ্জের পীতাম্বর দাসের সঙ্গে তার একসময় দহরম-মহরম ছিল।
বেরিয়ে এসে সে মহাদেবকে বলল, “কথাটা ফস কোরো না, কিন্তু কোথাও একটা গণ্ডগোল হচ্ছে। এ ছেলেটা পল্টু পাকড়াশি নয়।”
“অ্য। তবে এ কে?”
“মাধবগঞ্জের পীতাম্বর দাসের ছেলে নবীন।”
“হ্যাঁ বটে, শুনেছি ছোঁড়া নাকি নিজের ওই নামটাই বলছে। কেউ অবশ্য বিশ্বাস করেনি।”
“পল্টুর সঙ্গে বেচারার খুব মিল আছে। তাই ভাবছি ব্যাপারটা কী!”
“তা ছোঁড়াটাকে জিজ্ঞেস করলেই তো হয়।”
“সেপাইটা তো কথাই কইতে দিল না, দেখলে তো! বড়বাবুর নাকি নিষেধ আছে।”
“তা হলে কী করবে?”
“ক’টা দিন থাকতে হবে এখানে। কাণ্ডটা কী হয়, তা না দেখে যাচ্ছিই না।”
“সেই ভাল। চেপে বসে থাকো।”
আর গতকাল সকালেই কাণ্ডটা ঘটেছে। সাইকেলটায় পাম্প করাতে বটতলা ছাড়িয়ে মদনের সাইকেলের দোকানে গিয়েছিল বিশু। নিচু হয়ে যখন হাওয়া টাইট হয়েছে কি না দেখছিল, তখনই হঠাৎ নজর পড়ল, তিন জোড়া পা তার পিছন দিকে বাঁ থেকে ডাইনে যাচ্ছে। আড়চোখে তাকাতেই বিশু চমকে গেল। একজন নগেন পাকড়াশির পোষা গুন্ডা চণ্ডীচরণ, তার সঙ্গে ভাড়াটে খুনে বগা, আর তিন নম্বর লোকটা দাড়ি-গোঁফওয়ালা, চোখে রোদচশমা আর মাথায় টুপি থাকায় চেনা যাচ্ছিল না। কিন্তু ওই হাঁটার কায়দা আর ঘাড়ের উপর দিকে একটা কাটা দাগ দেখে পল্টুকে চিনতে তেমন অসুবিধেই হল না তার। অবিশ্বাস্য! নিজের চোখকেই তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। অবিকল সাপের মতোই একবার ফোঁস করল সে।
৯. মৃদুভাষিণী দেবী
মৃদুভাষিণী দেবীর একটা মুশকিল হয়েছে আজকাল। যখন আহ্নিকে বসেন বা যখন রাধাগোবিন্দ জিউর মন্দিরে যান কিংবা যখন সন্ধেবেলা পুরনো গির্জায় যিশুর মূর্তির সামনে মোমবাতি জ্বেলে দু’খানি বাতাসা ভোগ দেন, তখনও একই দেবতাকে দেখতে পান। ইষ্টদেবতা, রাধাগোবিন্দ জিউ আর যিশু একাকার হয়ে যাওয়ায় তার মুশকিলটা হয়। একদিন চক্কোত্তিমশাইয়ের কাছে ধন্ধটার কথা বলেওছিলেন। চক্কোত্তিমশাই বুড়ো মানুষ, জ্ঞানবৃদ্ধ। গুড়ক-গুড়ুক তামাক খেতে খেতে দুলে দুলে খুব হাসলেন। বললেন, “আমারও তো ওই গোলমাল গো ঠাকরোন। কাকে বাছি, কাকে রাখি। কত রূপ ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন…নিতি নব নটলীলা।”
“পাপ হচ্ছে না তো বাবা?”
“যিশু ভজলে পাপ হয় বুঝি? যে বলে সে আহাম্মক।”
“তা বলে সবাইকে সমান দেখা কি উচিত হচ্ছে বাবা?”
“যত উপরে উঠবি, তত সব সমান দেখবি। উপরে উঠবি তো নাম-বেলুন।”
“নাম মানে কি মন্তর নাকি বাবা?”
“হুঁ।”
মৃদুভাষিণী সেই থেকে সার বুঝেছেন। ভাঙা গির্জায় একা পড়ে থাকেন যিশুবাবা। বড় মায়া হয় তার।
আজ সন্ধের মুখে একটু হিমভাব। মৃদুভাষিণী সন্ধের সময়টায় যখন গির্জায় মোম জ্বেলে দিচ্ছেন, তখন আচমকা মনে হল, একটা বাচ্চা মেয়ের হাসির শব্দ শুনলেন যেন। খুশির হাসি।
চমকে উঠে চারদিকে চাইলেন, “কে রে? কে লুকিয়ে আছিস?”
আর কোনও শব্দ নেই। মৃদুভাষিণীর অবশ্য ভয় হল না। যিশুর মন্দিরে কি ভয়ের কিছু থাকতে পারে? তবে ভাবনা হল। সকালেই প্রাণপতির ফুটফুটে মেয়েটাকে কে যেন চুরি করে নিয়ে গিয়েছে। তার কোনও অমঙ্গল হল না তো!
যখন গির্জা থেকে বেরিয়ে দরজাটায় তালা দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছেন, তখন ফের শুনতে পেলেন গির্জার ভিতর একটা বাচ্চা মেয়ের হাসির শব্দ। না, শুধু হাসির শব্দই নয়, ছোট ছোট পায়ে গির্জার ভিতরে যেন ছোটাছুটি করছে এক শিশু, কার সঙ্গে যেন খেলছে।
জোড়হাতে মৃদুভাষিণী বিড়বিড় করে বললেন, “রক্ষে করো যিশুবাবা, রক্ষে করো।”
.
প্রাণপতি আজ নিজেকে নিজেই চিনতে পারছেন না। শুধু বুঝতে পারছেন তিনি আর আগের প্রাণপতি নেই। দার্শনিক প্রাণপতি কোথায় নিরুদ্দেশ হল এবং কেনই বা, সেটাই লাখ টাকার প্রশ্ন। কিন্তু তা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় তাঁর নেই।