নবীনের দম বন্ধ হয়ে চোখ উলটে ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। নগেন ফের আর্তনাদ করে উঠে বলল, “ওরে, ছেড়ে দে, ওকে ভড়কে দিসনি। তোতাই-পাতাই করে রাজি না করালে হবে না বাপু। ও বিগড়ে গেলে যে পল্টুর প্রাণ সংশয়!”
চণ্ডীচরণ তাকে ছেড়ে তো দিলই, তারপর তাকে খাতির করে চেয়ারে বসিয়ে ময়রার দোকান থেকে গরমাগরম কচুরি আর জিলিপি আনিয়ে খাওয়ানো হল।
নগেন পাকড়াশি একটা বড়সড় চটের থলি তার হাতে দিয়ে বলল, “এই নে বাপু, পুরো পাঁচ লাখ আছে। সাবধানে রাখিস, খোয়া-টোয়া না যায়। নামে চোদ্দো বছর, আসলে সাত-আট বছরের বেশি তো নয় রে। তা সাত-আট বছর পর তোর বয়স হবে মেরেকেটে তিরিশ। বাকি জীবনটা পায়ের উপর পা তুলে আরামে কাটিয়ে দিতে পারবি। এখন যা, আমার পাইকরা তোকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে।”
পাঁচ লাখ টাকা পেয়ে নবীন যেন কেমনধারা ভোম্বল হয়ে গেল। এত টাকা! তাদের সাত পুরুষেও কেউ এত টাকা চোখে দেখেনি। কিন্তু টাকাটা কোথায় গচ্ছিত রেখে যাবে, সেইটেই ভেবে পাচ্ছিল নবীন।
তার পাড়াতুতো এক পিসি আছে, ননীবালা। তিরানব্বই বছর বয়স এবং নবীনের মতোই তারও তিন কুলে কেউ নেই। আর সেইজন্যই বুড়ি একটু নবীনের ডাক-খোঁজ করে, মোয়াটা, নাড়ুটা খাওয়ায়। টাকার পোঁটলা নিয়ে নবীন যখন এক দুপুরবেলা ননীপিসির কাছে হাজির হল, তখন প্রস্তাব শুনে পিসির মূৰ্ছা যাওয়ার জোগাড়। বলল, “বলিস কী বাছা! এই ভাঙা ঘরে থাকি, ও টাকা আমি কোথায় লুকোব? তারপর সাত-আট বছরের কথা বলছিস, ততদিন কি আমি বাঁচব রে? তা বাপু, ও টাকা পেলি কোথায়? চুরি-ডাকাতির টাকা নয় তো!”
“না পিসি, ন্যায্য টাকা। পরে সব বুঝিয়ে বলব।”
এর পর সাইকেল আর ঘড়ি বেচে দিল নবীন। সেই টাকায় আরও ভালমন্দ খেল, নতুন জামা কিনল একটা, দীনদুঃখীদের কিছু দিল-থুল। দানধ্যান তো জীবনে করার ফুরসত পায়নি।
তারপর এক ঝড়-জলের রাতে বন্দোবস্ত মতো নগেনের পাইকরা তাকে নিয়ে গিয়ে জেলের ফটকের কাছে হাজির করল। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেপাইরা তাকে ভিতরে নিয়ে গিয়ে নানা চোরা পথ পার হয়ে একটা গরাদওয়ালা খুপরি ঘরে ঢুকিয়ে তালা বন্ধ করে দিল।
জেলখানা জায়গাটা খুব একটা খারাপও লাগছিল না নবীনের। খেতে-টেতে দেয়, শোওয়ার জন্য কম্বল আছে, মাথার উপর ছাদ, আর চাই কী? কিন্তু দু-চার দিনের মধ্যেই সে কানাঘুষো শুনতে পেল যে, যাবজ্জীবন নয়, সে আসলে ফাঁসির আসামি। কেস নাকি এখন হাইকোর্টে, যে-কোনও দিন রায় বেরোবে।
এই খবরে নবীনের চুল খাড়া হয়ে উঠল। সর্বনাশ! নগেন পাকড়াশি তো সাংঘাতিক লোক! পল্টুর যে ফঁসির হুকুম হয়েছে, এটা তো সে নবীনকে বলেনি! শুনে সে খুব চেঁচামেচি শুরু করে দিল, “ওগো, তোমরা সবাই শোনো! আমি কিন্তু পল্টু নই। আমি হলুম নবীন দাস। মাধবগঞ্জের পীতাম্বর দাসের ছেলে।”
তার চেঁচামেচিকে কেউ পাত্তাই দিল না। শুধু মোটামতো একজন সেপাই এসে খুব ভালমানুষের মতো বলল, “ফাঁসির হুকুম হলে অনেকেরই তোমার মতো হয়। তবে ভয় খেয়ো না, ভাল করে খাও-দাও। ফঁসি যখন হবে, তখন হবে। ভেবে লাভ কী?”
শুনে নবীন তার খুপরিতে বসে বিস্তর কান্নাকাটি করল। লোভে পড়ে নিজের প্রাণটাকে এরকম উচ্ছ্বঘ্ন করাটা কি ঠিক হল তার? নগেনের কথায় বিশ্বাস করাটাও তার ভারী আহাম্মকি হয়েছে।
তার খাওয়া কমে গেল। ঘুম হতে চায় না। শরীর দুর্বল লাগে। মাথা ঝিমঝিম করে।
জেলে যাওয়ার মাসছয়েক বাদে হঠাৎ একদিন সকালে এক উকিলবাবু এলেন। তাকে দেখে হা হয়ে গেল নবীন। মনোমাস্টারের ছেলে শিবুদাদা। কয়েক বছর আগেও মনোরঞ্জন মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি দুধ দোয়াতে গিয়েছে নবীন। তখন মনোমাস্টার তাকে পড়াত।
“শিবুদাদা! আমি নবীন!”
শিবপদ উকিল অবাক চোখে তার দিকে চেয়ে বলল, “তাই তো রে! থানার এক সেপাই আমাকে ক’দিন আগে চুপিচুপি খবর দিয়েছিল বটে, আসামি অদলবদল হয়েছে! তখন বিশ্বাস হয়নি।
এখন তো দেখছি, ঠিকই শুনেছি। ব্যাপারটা কী বল তো!”
নবীন হাউমাউ করে খানিক কেঁদে, খানিক ককিয়ে গোটা ঘটনাটা বলে গেল।
শিবপদ চিন্তিত মুখে বলল, “সর্বনাশ করেছিস। এখন যদি প্রমাণও হয় যে, তুই পল্টু নোস, তা হলে বিস্তর হ্যাপা আছে। সরকার এবং আদালতকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য তোর নামে মামলা হবে। আসামি বদলের জন্য জেলারসাহেবের চাকরি যাবে। তার উপর পল্টুর নামে হুলিয়া জারি হবে।”
“তা হলে আমার কী হবে শিবুদাদা?”
“দাঁড়া, ব্যাপারটা সহজ নয়। খুব ভাল করে উপায় ভাবতে হবে।”
কয়েকদিন উৎকণ্ঠায় থাকার পর একদিন শিবপদ গম্ভীর মুখে এসে বলল, “একটা উপায় হয়েছে। তোকে জেল থেকে পালাতে হবে।”
চোখ বড় বড় করে নবীন বলল, “কী করে পালাব শিবুদাদা? চারদিকে যে পাহারা!”
“সে তোকে ভাবতে হবে না। তোকে পালাতে না দিলে জেলারসাহেব আর তার কর্মচারীদেরও বিপদ। তারাই তোকে পালাতে দেবে।”
একগাল হেসে নবীন বলে, “তা হলে তো বড্ড ভালই হয়।” শিবপদ মাথা নেড়ে বলল, “না, হয় না। তুই পালালেও তোর বিপদ কাটবে না। পুলিশ তোকে খুঁজবে না ঠিকই, কিন্তু নগেন পাকড়াশি ছাড়ার পাত্র নয়। কারণ, তুই পালালে পুলিশ এখন হন্যে হয়ে পল্টুকে খুঁজবে। আর নগেনের উপর উৎপাত বাড়বে। কাজেই ছাড়া পেলে গা ঢাকা দিয়ে থাকিস। খবরদার, নিজের বাড়ি বা গাঁয়ের ধারে-কাছে যাস না।”