“কী জানি বড়বাবু, ভুলও দেখতে পারি। তখন ভয়ে, দুশ্চিন্তায় মাথার কি ঠিক ছিল?”
“মুশকিল হল, এই গাঁয়ের আরও দু’জন মানুষও লোকটাকে দেখেছে। লোকটা কে হতে পারে তাই ভাবছি। এখন তোমাকে যা বলছি, তা মন দিয়ে শোনো৷”
“আজ্ঞে, বলুন।”
“তোমাকে আজ রাত ঠিক বারোটায় আমি ছেড়ে দেব।”
“ছেড়ে দেবেন! বাপ রে! তা হলে যে ওরা আমাকে জানে মেরে দেবে বড়বাবু!”
.
হোঁচট খেয়ে গদাম করে একটা আছাড় খাওয়ার পর সংবিৎ ফিরে পেল অবনী। এই ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে অচেনা জায়গায় দৌড়নো তার ঠিক হয়নি। পড়ে গিয়ে হাঁটু জ্বালা করছে, হাতের তেলো ছড়ে গিয়েছে এবং মাথাটাও ঝিমঝিম করছে। সে লাঠিটা কুড়িয়ে নিয়ে একটু কষ্ট করেই উঠে দাঁড়াল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই বিপজ্জনক অষ্টপুর ছেড়ে তার না পালালেই নয়। কিন্তু দৌড় দিতে গিয়ে এবং আছড়ে পড়ে তার মাথা গুলিয়ে গিয়েছে। কোন দিকে যাবে, তা বুঝতে পারছে না।
পিছনে কারও পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে কি? একটু কান পেতে শোনবার চেষ্টা করল অবনী। হা, পায়ের শব্দই বটে। একজন নয়, অন্তত তিন-চারজনের।
অবনীর আর দাঁড়ানোর সাহস হল না। সে ফের ছুটবার একটা মরিয়া চেষ্টা করল। এবং টের পেল সে একটা জংলা জায়গায় ঢুকে পড়েছে। জঙ্গল এক রকম মন্দ নয়। তাতে খানিক আড়াল হবে। কিন্তু জায়গাটায় খানাখন্দ আছে। দু’-তিনবার ছোট ছোট গর্তে পা পড়ে গেল।
একটু ঘন গাছপালার আবডাল পেয়ে দাঁড়াল অবনী। পিছনে যারা আসছিল, তারা আরও কাছে এসে পড়েছে। তাদের হাতে টর্চ জ্বলছে এবং নিভছে। কাছাকাছি আসবার পর অবনী দেখল, তিনটে লোক একজন লোককে ধরে টানতে টানতে নিয়ে আসছে। দৃশ্যটা ভারী অস্বস্তিকর। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, লোক তিনটের মতলব ভাল নয়।
সেটা আরও ভাল করে বোঝা গেল, টর্চের আলোয় একজনের হাতে একটা ছোরা ঝিকিয়ে উঠবার পর।
না, অষ্টপুর জায়গাটা সত্যিই যাচ্ছেতাই। ভদ্রলোকের বসবাসের যোগ্য নয়। শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখাটা ঠিক হবে কি না সেটাই ভাবতে লাগল অবনী।
লোকগুলো মাত্র কয়েক হাত দূর দিয়ে ডানধারে চলে যাচ্ছিল। অবনী শুনতে পেল, কে যেন কাতর স্বরে বলছে, “আমাকে ছেড়ে দাও তোমরা। আমার তো ফাঁসিই হবে।”
জবাবে কে যেন বলল, “ফাঁসির আগে যে অনেক কথা ফাঁস হয়ে যাবে বাবা।”
টর্চের আলোয় ছেলেটার মুখটাও এক ঝলক দেখতে পেল অবনী। সর্বনাশ! এ তো সেই পল্টু পাকড়াশি! অবনীর বীরত্বে যে হাটুরে মার খেয়ে ধরা পড়েছিল! না! আর এক মুহূর্তও অষ্টপুরে নয়। জীবনে সে আর কোনও বীরত্বের কাজও করতে যাবে না। আর অষ্টপুরের গুন্ডারা যতদিন না তাকে ভুলে যায়, ততদিন অবনী অষ্টপুরে আসবেও না। গুন্ডাগুলো যেদিকে গেল, তার উলটোবাগে পড়ি কি মরি করে ছুটতে লাগল অবনী।
.
থানা থেকে বেরিয়ে নিজের গাঁয়েই ফিরে যাওয়ার কথা ভেবেছিল ভুবন। কিন্তু পল্টু পাকড়াশি যে ধরা পড়েনি, এই চিন্তাটাও বড় উচাটন করছিল তাকে। আজকের দিনটা ভাল নয়। প্রাতঃকালেই মা মনসার জীবটাকে মারতে হল। কী হয় কে জানে।
উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে হাঁটতে ভুবন একটা নিরিবিলি জায়গায় পুরনো শ্যাওলাধরা গির্জা দেখতে পেয়ে দাঁড়াল। জরাজীর্ণ অবস্থা বটে, কিন্তু নোংরা নয়। সে পায়ে-পায়ে গিয়ে সামনের ছোট্ট চাতালটায় বসে দেওয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বুজল।
মেজাজটা ভাল নেই ভুবনের। সকালে যে স্বপ্নটা দেখল, তারও মাথামুন্ডু বুঝতে পারেনি সে। স্বপ্নটগ্ন বড় একটা দেখে না ভুবন। সারাদিন খেতখামারে অসুরের মতো খেটেপিটে এসে এক থালা ভাত মেরে দিয়ে মোষের মতো ঘুমোয়। বহুদিন পর আজ স্বপ্ন দেখল। লম্বা একটা টেকো লোক কী সব ভাল ভাল কথা বলছিল যেন! কিন্তু ভাল কথা দিয়ে কি জীবন চলে! কিন্তু তার সন্দেহ হচ্ছে, স্বপ্নটার সঙ্গে বাস্তব ঘটনার কিছু যোগাযোগও থাকতে পারে। তবে বড্ড গোলমেলে ব্যাপার। পল্টুর বদলে অন্য একটা লোককে ধরে আটকে রাখা হয়েছে কেন, তাও সে বুঝতে পারছে না। পল্টু কি তা হলে পালিয়েছে? ভুবন জানে, তার বুদ্ধিশুদ্ধি নেই। সে একজন বোকা চাষা মাত্র। ভাবনাচিন্তা তার আসে না। সেই অনভ্যাসের কাজটা করতে গিয়ে তার মাথাটাই গুলিয়ে যাচ্ছে।
মিঠে হাওয়া দিচ্ছিল খুব। চারদিকে গাছগাছালির ঝিরিঝিরি ছায়া। শরীরেরও ধকল গিয়েছে মন্দ নয়। ভুবন ঘুমিয়ে পড়ল।
যখন ঘুম ভাঙল, তখন দেখে, সামনে একটা লোক পঁড়িয়ে তাকে খুব ঠাহর করে দেখছে। মুখে দাড়িগোঁফ আছে, রোগাপানা, পরনে লুঙ্গি আর কামিজ। তাকে চোখ চাইতে দেখে বলল, “নতুন লোক দেখছি যে!”
ভুবন একটা হাই তুলে শুধু বলল, “হুঁ।”
“অষ্টপুর গাঁয়ে বাইরের মানুষের আনাগোনা বিশেষ নেই। গতকাল থেকে দেখছি, খুব বাইরের লোক এসে ঢুকে পড়েছে।”
ভুবন বলে “কেন, বাইরের লোক এলে কী হয়?”
লোকটা সিঁড়ির একটা ধাপে বসে কাঁধের গামছা দিয়ে মুখের ঘাম মুছে বলে, “ভালটা কী হচ্ছে বলল! এই তো আজ সকালে দারোগাবাবুর মেয়েটা চুরি হয়ে গেল।”
ভুবন সটান হয়ে বসে বলল, “অ্যাঁ!”
“তবেই বোঝো, বাইরের লোকের আনাগোনা হচ্ছে কেন।”
“কে চুরি করল?”
“সে কি আর তার নাম, ধাম, ঠিকানা লিখে রেখে গিয়েছে বাপু?”
ভুবন খুব চিন্তিত মুখে বলল, “হুঁ।”
“তোমার কোথা থেকে আগমন হচ্ছে?”