গলাটা চিনতে পেরে একটু ধাতস্থ হল অবনী। ভয়ের তেমন কিছু নেই, এ হল ঘণ্টাপাগলা। একটা নিশ্চিন্দির শ্বাস ফেলে সে বলল, “তা তুমি ঘুমোওনি?”
ঘণ্টা অবাক হয়ে বলে, “আমি ঘুমোব কী মশাই, আমার কি ঘুমোলে চলে? এই গোটা অষ্টপুর তা হলে দেখাশোনা করবে কে? আমি ছাড়া আর কার গরজ আছে বলুন। সব কিছু তো আমাকেই দেখেশুনে রাখতে হয়!”
“তা অবশ্য বটে।”
“এই গোটা অষ্টপুরের সব খবর আমার নখদর্পণে। কোন গাছের ক’টা পাতা খসল, ক’টা গজাল, নন্দবাবুর গোরুটা যে বাছুর বিয়াল, সেটা এঁড়ে না বকনা, শচীপিসির বাঁ হাঁটুতে বাত না ডান হাঁটুতে, পোস্ত খেলে যে পাঁচকড়ির পেটে ব্যথা হয়, এসব খবর আর কে দেবে আপনাকে বলুন তো!”
“তাই তো হে! এসব গুরুতর খবর তো আমার জানা ছিল না।”
ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঘণ্টা বলল, “তবু অবিচারটা দেখুন, অষ্টপুরে এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল। কিন্তু আমিই টের পেলুম না।”
“কী ঘটনা বল তো!”
“প্রাণপতি দারোগার জায়গায় যে নতুন দারোগা এসেছে জামাইবাবু।”
“তাই নাকি?”
“কেমন নরমসরম ভোলাভালা দারোগাটা ছিল আমাদের। তার বদলে এসেছে এক বদরাগী, মারমুখো দারোগা। কটমট করে তাকায়, দাঁত কড়মড় করে কথা কয়, গাঁক গাঁক করে চেঁচায়।”
“তা হলে তো ভয়ের কথা!”
“আজ্ঞে, খুবই ভয়ের কথা। তবে কিনা অষ্টপুরে ভয়-ভীতির অনেক জিনিস আছে। কিন্তু ভয় পেলে কি আমার চলে বলুন! তা হলে অষ্টপুরের দেখাশুনো করতে পারতুম কি?”
“সে তো ঠিকই।”
“তা জামাইবাবু, একটা কথা বলব?”
“বলে ফ্যালো।”
“আপনি কেন লাঠি হাতে নিশুতি রাতে বেরিয়ে পড়েছেন, তা কিন্তু আমি জানি।”
অবনী একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলে, “কী বলো তো!”
“আপনি চোর-ডাকাত ধরতে বেরিয়েছেন, তাই না? অষ্টপুরের সবাই বলে, আচার্যিবাবুর ছোট জামাইটা খুব বাহাদুর আছে।”
অবনী আঁতকে উঠে বলে, “ওরে বাবা! না হে বাপু, আমি মোটেই চোর-ডাকাত ধরতে বেরোইনি। ও কথা শোনাও পাপ। আমি বাপু, একটু হাওয়া খেতেই বেরিয়েছি।”
“আপনার সঙ্গে আমার খুব মিল। আমারও ভয়ডর নেই কিনা।”
“না হে বাপু ঘণ্টা, আমার মোটেই তোমার মতো সাহস নেই।”
“কী যে বলেন জামাইবাবু, সবাই জানে আপনি অষ্টপুরের সব গুন্ডা-বদমাশদের একদিন ঠান্ডা করে দেবেন।”
“ওরে বাপ রে, ও কথা বলতে নেই হে ঘণ্টা। অষ্টপুর খুব ভাল জায়গা। এখানে মোটেই গুন্ডা-বদমাশ নেই। আমি বরং এগিয়ে যাই, একটু তাড়া আছে হে।”
ঘণ্টা পিছন থেকে চেঁচিয়ে বলল, “আপনি কিছু ভাববেন না জামাইবাবু, আমি আপনাকে অষ্টপুরের সব কটা চোর-ডাকাত গুন্ডা আর বদমাশকে চিনিয়ে দেব।”
অবনী দু হাতে দু’ কান চাপা দিয়ে একরকম দৌড়তে লাগল। অষ্টপুরে আর তিলার্ধ থাকা চলবে না। সামনে বড়ই বিপদ। কী কুক্ষণে যে ঘণ্টার সঙ্গে দেখা হয়েছিল!
.
কোন কয়েদির না ছাড়া পেতে ভাল লাগে? বিশেষ করে ফাঁসির আসামির!
কিন্তু রাত বারোটার একটু আগে যখন প্রাণপতি, পলু পাকড়াশি ওরফে নবীন দাসের লকআপে গিয়ে উঁকি দিলেন, তখন নবীন ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে।
প্রাণপতি গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করলেন, “কী খবর হে পল্টু?”
ছেলেটা তার দিকে চেয়ে কঁপা গলায় বলল, “বড়বাবু, আমাকে বাঁচান। পল্টু পাকড়াশি, চণ্ডী আর বগা তিনজন আমাকে খুন করতে এসেছে। একটু আগেই আমার আত্মীয় বলে পরিচয় দিয়ে এসে দেখে গিয়েছে আমায়।”
“পল্টু পাকড়াশি! সে তো তুমিই হে!”
“না বড়বাবু। আমি তো নকল পল্টু। আমি আসল পল্টুর কথা বলছি।”
“তুমি আসল নও?”
“আজ্ঞে, না বড়বাবু। আমি মাধবগঞ্জের নবীন দাস। সবাই জানে।”
“বগা আর চণ্ডী কে?”
“তারা নগেন পাকড়াশির লোক।”
“তারা তোমাকে মারতে চায় কেন?” মাথা নেড়ে নবীন বলে, “তা জানি না। পল্টুর চোখ দেখে আমি বড় ভয় পেয়েছি বড়বাবু। আমার বড় শীত করছে। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।”
প্রাণপতি গম্ভীর হয়ে বললেন, “হুঁ, বুঝলাম। কিন্তু পল্টুর হাত থেকে বাঁচলেও ফাঁসির দড়ি তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।”
নবীন হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
“কাঁদলে কি বাঁচতে পারবে?”
গারদের চাবিটা খুলে প্রাণপতি বললেন, “উঠে এসো। তোমার সঙ্গে একটু কথা আছে।”
কম্বল মুড়ি দিয়েই উঠে এল নবীন। তাকে মুখোমুখি চেয়ারে বসিয়ে প্রাণপতি বললেন, “ওই তিনজনের মধ্যে একজন কি খুব লম্বা, রোগাপানা, মাথায় টাক, চোখদুটো কটা আর গায়ে আলখাল্লার মতো পোশাক?”
নবীন অবাক হয়ে বলল, “না তো!”
“ভাল করে ভেবে বলো।”
“আজ্ঞে না। ওদের মধ্যে ওরকম তোক কেউ নেই।”
“এরকম চেহারার কোনও লোককে চেনো?”
নবীন একটু ভেবে বলল, “চিনি না। তবে সেদিন ওরকম চেহারার একজনকে গির্জা ঝাট দিতে দেখেছিলাম।”
“গির্জা!”
“হ্যাঁ। শীতলসাহেবের গির্জা।”
“ওই গির্জা বহুকাল ব্যবহার হয় না। পুরনো ঝুরঝুরে হয়ে গিয়েছে বলে বন্ধ রয়েছে। বিপজ্জনক বাড়ি, যে-কোনওদিন ভেঙে পড়তে পারে। ওই গির্জায় কে ঝট দিতে আসবে!”
নবীন মাথা নেড়ে বলে, “আমি অতশত জানি না। গির্জার দরজাটা একটু ফাঁক করেছিলাম, তখন দেখি, ঠিক ওইরকম চেহারার একজন লোক খুব যত্ন করে ডান্ডি লাগানো বুরুশ দিয়ে ধুলো-ময়লা সাফ করছে।”
“খুবই অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার। এরকম ঘটার কথা নয়। ওই গির্জায় কেউ থাকে না। তবে পুরনো গির্জা ভেঙে আবার নতুন করে গির্জা তৈরির তোড়জোড় চলছে। তুমি ভুল দেখোনি তো!”