“এই তো গত কালই সকালবেলায় এসে আমাদের ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে আমার উপর নজর রাখছিল।”
মৃদুভাষিণী মাথা নেড়ে বললেন, “তাকে খোঁজবার আর দরকার নেই বাবা। সে নিজেই তোমাকে ঠিক খুঁজে নেবে। ভেবো না। খুঁজলেও তাকে অত সহজে পাওয়া যাবে না।”
“আপনিও কি তাকে চেনেন মাসিমা?”
“চিনি বাবা। আমি চিনি, ওই উদ্ধব হতভাগা চেনে। তুমিও চিনতে পারবে। তবে এমনিতে চেনা বড় মুশকিল। দেখা পাওয়া আরও মুশকিল।”
“এ যে হেঁয়ালি হয়ে যাচ্ছে মাসিমা?”
মৃদুভাষিণী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, “হেঁয়ালিই মনে হয় বাবা। এ যুগে কি আর ওসব কেউ বিশ্বাস করে?”
৮. অবনী ঘোষালের স্নান-খাওয়া নেই
দু’ দিন হল অবনী ঘোষালের স্নান-খাওয়া নেই। না না, কথাটা ভুল হল। স্নান আছে, খাওয়া নেই। দুশ্চিন্তায় এবং দুর্ভাবনায় মাথাটা মাঝে-মাঝেই বড্ড গরম হয়ে যাচ্ছে বলে এই শরতের শুরুতে অষ্টপুরে একটু একটু ঠান্ডা পড়ে যাওয়া সত্ত্বেও অবনী দিনে পাঁচ থেকে সাতবার ঠান্ডা জলে স্নান করছে। কিন্তু খেতে বসলেই মনে হয়, তার পাকস্থলীতে হরতাল চলছে, কণ্ঠনালীতে চলছে পথ অবরোধ। তেলালো মাছের কালিয়া, মুরগির মোগলাই, মুড়ো দিয়ে সোনামুগের ডাল, মুড়িঘন্ট, বিরিয়ানি বা পায়েস সব গলা পর্যন্ত গিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে আসছে। তাঁর অরুচি দেখে শাশুড়ি আর্তনাদ করছেন, শ্বশুর দুশ্চিন্তায় ছাদে পায়চারি করছেন, তাঁর স্ত্রী তাঁকে কোষ্ঠ পরিষ্কারের ওষুধ গেলাচ্ছে। কিন্তু অবনীই একমাত্র জানে তার অরুচি কেন। কিন্তু কারণটা কাউকে লজ্জায় বলতেও পারছে না সে। নতুন জামাইকে যদি সবাই ভিতু ভাবে, তা হলে বড় লজ্জার কথা। এই তো মাত্র তিনদিন আগে সে অত বড় একটা বীরত্বের কাজ করেছে। সুখ্যাতিও হয়েছে মেলাই। সেই বেলুনটা চুপসে গেলে সে কি আর কোনওদিন শ্বশুরবাড়ির গাঁয়ে মুখ দেখাতে পারবে?
কিন্তু প্রাণের মায়া বড় মায়া। কদিন আগেও অষ্টপুরকে তার বড় ভাল লাগত। এখন মনে হচ্ছে, অষ্টপুরই যত নষ্টের গোড়া। নিতান্ত আহাম্মক ছাড়া অষ্টপুরে কেউ মরতে বিয়ে করতে আসে? বরং কেষ্টপুরে বিয়ে করলেই ভাল হত। অবনী রাতে চোখ বুজলেই দেখতে পায়, অষ্টপুরের গুন্ডা-বদমাশরা তাকে ঘিরে ধরে ডান্ডাপেটা করছে, রড দিয়ে হাত-পা ভাঙছে, চপার দিয়ে কোপাচ্ছে, দা দিয়ে টুকরো টুকরো করছে। সে আরও দেখতে পায়, তার বউ সজল চোখে তাকে বিদায় জানাচ্ছে আর বলছে ‘যেতে নাহি দিব’, তারপর অষ্টপুর শ্মশানে…ওঃ, আর ভাবতে পারে না অবনী। মাথা ঠান্ডা করতে মাঝরাতে উঠেও চান করতে হয় তাকে।
নিশুত রাতে জেগেই ছিল অবনী। দু দিন হল, ঘুমের সঙ্গে তার মুখ দেখাদেখি বন্ধ। শুনশান মধ্যরাতে উঠে বসে তার মনে হল, অষ্টপুরের গুন্ডা-বদমাশদেরও কি আর রাতের ঘুম বা বিশ্রাম বলে কিছু নেই? নিশ্চয়ই আছে। সুতরাং এই সময়ে যদি কালো পোশাকে, মুখে একটা কিছু ঢাকা-চাপা দিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে, তা হলে কেমন হয়? রিস্ক হয়তো একটু আছে, কিন্তু ওখানে বসে থেকে মৃত্যুর প্রহর গোনার চেয়ে এটুকু বিপদের ঝুঁকি নেওয়াই উচিত।
অবনী সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করল না। মালপত্র আছে থাক। সকালে উঠে তাকে খুঁজে না পেলে শ্বশুরবাড়ির লোক এবং তার বউ দুশ্চিন্তা করবে সন্দেহ নেই। হয়তো ভাববে সন্ন্যাসী হয়ে গিয়েছে, হয়তো ভাববে অপহরণ। কিন্তু সেসব নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই তার। প্রাণ আগে, না লৌকিকতা আগে?
কালো না হলেও কালচে রঙের প্যান্ট-শার্ট পরে নিল অবনী। একটা মাফলার দিয়ে মুখ ঢেকে নিল। তারপর চুপিসারে দোতলা থেকে নেমে কম্পিত বক্ষে ঠাকুর দেবতাকে স্মরণ করতে করতে বেরিয়ে পড়ল। বারান্দায় শ্বশুরমশাইয়ের কয়েক গাছা লাঠি একটা স্ট্যান্ডে রাখা ছিল। তা থেকে একটা বেশ মজবুত লাঠিও সঙ্গে নিল সে। বিপদে পড়লে খানিকটা কাজে দেবে।
বাইরে নিকষ্যি অন্ধকার। অবনী নিশ্চিন্ত হয়ে বেরিয়ে পড়ল।
.
অন্ধকার হলেও রাস্তার একটা আন্দাজ আছে অবনীর। বাঁ হাতে খানিক হেঁটে ডান ধারে মোড় ফিরে গির্জা পর্যন্ত গেলেই বাঁ ধারে নীলকুঠির জঙ্গল। ফস্টারসাহেবের বাড়ির ধার ঘেঁষেই গাঁয়ের বাইরে যাওয়ার রাস্তা। নিরিবিলি আছে, তোকজনের যাতায়াত বিশেষ নেই ওদিকে। মাইল দুই পথ মেরে দিলেই কুঁকড়োহাটি। তারপর আর পায় কে অবনীকে! বগল বাজিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে পারবে সে। এই পথটুকুই যা দুশ্চিন্তার।
অন্ধকার বলে পা চালিয়ে চলবার উপায় নেই। মোড় বরাবর যেতেই অনেকটা সময় গেল। তারপরও ঘাপটি মেরে থাকতে হল কিছুক্ষণ। রাতপাহারায় চৌকিদাররা হুইসল বাজিয়ে ডান ধার থেকে বাঁ ধারে গেল। রাস্তা ফাঁকা বুঝে সাবধানে মোড় পেরিয়ে ডান দিকের রাস্তা ধরল অবনী।
ভারী বিনয়ী গলায় পাশ থেকেই কে যেন বলে উঠল, “জামাইবাবু কি মর্নিং ওয়াকে বেরোলেন নাকি?”
মেরুদণ্ড বেয়ে যেন একটা সাপ নেমে গেল অবনীর। হাত-পা ঠান্ডা। শরীর কাঠ। তোতলাতে তোতলাতে কোনওক্রমে বলল, “না, এই একটু…”
“বড় হুটোপাটি করে বেরিয়ে পড়েছেন মশাই, এই তো থানার ঘড়িতে মোটে রাত দুটো বাজল। এই সময়ে সব চোর ছ্যাচড়রা বেরোয়। এই তো দেখে এলুম, গড়ান সাধুখাঁ পালপাড়ার গৌরহরিবাবুর ঘরের গ্রিল কাটছে। পবন সাউ চৌপথীর কাছে পাইপ বেয়ে গিরিধারীবাবুর দোতলায় উঠছে। বিপিন দাসকে তো দেখলুম সুখেন গোসাঁইয়ের বাড়ি থেকে এককাড়ি বাসনকোসন আর একগাদা জামাকাপড় নিয়ে পিছনের জানলা গলে বেরিয়ে এল। নিতাই মোদক বাজারের মহাজনের গুদোমে এই বড় সিঁদ কেটে ফেলেছে।”