ঘণ্টাপাগলা ভারী ক্ষুব্ধ হয়ে বলল, “খুন কররানি মানে? তুমি যে বললে, নিশাপতি না হয় তো উমেশ, গিরীন সামন্ত কিংবা ধনপতি, কাকে যেন মেরেছ?”
প্রাণপতি একটা পেল্লায় ধমক দিয়ে বললেন, “চোপ!” ঘণ্টা ধমকের শব্দে আঁতকে উঠল। প্রাণপতি বললেন, “এদের প্রত্যেকের সঙ্গেই একটু আগে আমার বাজারে দেখা হয়েছে। কিন্তু তুমি কে হে বাপু? কী চাও?”
দৈত্যটা হাত জোড় করে বলল, “আজ্ঞে, আমার নাম ভুবন মণ্ডল। পল্টু পাকড়াশির হাতে আমার ছোট ভাই খুন হয়। শুনেছি পল্টু সদরের জেল থেকে পালিয়েছে। তাকে খুঁজতেই আসা।”
“আর খুঁজতে হবে না। সে আমাদের হেফাজতেই আছে। শিগগিরই সদর থেকে ফোর্স এসে তাকে নিয়ে যাবে।”
“একটু কথা আছে হুজুর। এই পাগলাটা বলছে, আপনাদের হেফাজতে যে আছে সে নাকি পল্টু পাকড়াশি নয়, অন্য লোক!”
“হুঁ, আসামি নিজেও তাই বলছে। সে নাকি নবীন দাস। ফুঃ!”
“হুঁজুর যদি অনুমতি করেন, তা হলে একবার চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জন করে যাই।”
প্রাণপতি এমন কটমট করে তাকালেন যে, ভুবন মণ্ডল জড়সড় হয়ে এক ফুটের মতো বেঁটে হয়ে গেল। প্রাণপতি ফোঁস করে একটা রাগের হলকা শ্বাস ফেলে বললেন, “কোনওরকম চালাকি করার চেষ্টা করলে কিন্তু সুবিধে হবে না বাপু।”
“আজ্ঞে না হুজুর, আপনার সঙ্গে বেয়াদপি করব, আমার ঘাড়ে ক’টা মাথা?”
ঘণ্টাপাগলা দারোগাবাবুকে যত দেখছে, ততই ধন্ধে পড়ে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ মাথাটাথা চুলকে হঠাৎ একগাল হেসে বলল, “এইবার বুঝতে পেরেছি।”
প্রাণপতি ভ্রু কুঁচকে করাল দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে বললেন, “কী বুঝতে পেরেছিস?”
“আপনি যে তিনি নন!”
প্রাণপতি ফুঁসে উঠে বললেন, “তার মানে?”
“প্রাণপতি খাসনবিশ বদলি হয়ে গিয়ে আপনি নতুন দারোগাবাবু এসেছেন তো! এটাই এতক্ষণ বুঝতে পারিনি মশাই। তবে কেমন যেন মনে হচ্ছিল, ইনি আমাদের সেই ভালমানুষ দারোগাবাবুটি নন। এই এতক্ষণে সব পরিষ্কার হয়ে গেল।”
প্রাণপতি ক্রুর দৃষ্টিতে ঘণ্টার দিকে চেয়ে বললেন, “হুঁ, কথাটা যেন মনে থাকে। আমি আর সেই আমি নই।”
এরপর প্রাণপতি ভুবন মণ্ডলের দিকে চেয়ে বললেন, “কুডুল বড় ভাল জিনিস নয়। কাজে লাগে, অকাজেও লাগে।”
“যে আজ্ঞে।”
“কুডুলখানা দরওয়াজার কাছে জমা দিয়ে তুমি আসামিকে দেখে আসতে পারো। যাবে আর আসবে। মনে থাকে যেন।”
আজ প্রাণপতির বজ্রগম্ভীর গলায় থানা যেন গমগম করতে লাগল। ভুবন মণ্ডল তটস্থ হয়ে একটা পেন্নাম ঠুকে ফেলল। এরকম জবরদস্ত দারোগা সে জন্মেও দেখেনি।
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ঘুরে এসে ভুবন মণ্ডল বলল, “হুঁজুর, মা মনসার দিব্যি কেটে বলতে পারি, এ লোক কস্মিনকালেও পল্টু পাকড়াশি নয়। চেহারার মিল আছে বটে, কিন্তু পল্টু পাকড়াশির চোখ দেখলে সাপ পর্যন্ত পথ ছেড়ে দেয়।”
“কিন্তু প্রমাণ?”
মাথা নেড়ে ভুবন মণ্ডল বলে, “প্রমাণ নেই হুজুর। তবে একে ফঁসি দিলে বড় অধর্ম হবে।”
চিন্তিত প্রাণপতি গম্ভীর ভাবে শুধু বললেন, “হুঁ।”
ঘণ্টা খানেক বাদে তার বাড়ি থেকে খবর এল, তার মেয়ে আট বছরের মধুছন্দা স্কুল থেকে বাড়ি ফেরেনি। কোথাও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রাণপতির স্ত্রী বিজু অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন।
হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে এসে তিনি দেখেন, পাড়াপ্রতিবেশীদের ভিড়ে বাড়ি গিজগিজ করছে। ভিড়ের ভিতর থেকে একজন এগিয়ে এসে একটা ভাঁজ করা কাগজ প্রাণপতিকে দিয়ে বলল, “এটা বউদির মুঠোয় ধরা ছিল।”
এক্সারসাইজ বুক থেকে ছেঁড়া পাতায় বিচ্ছিরি হাতের লেখায় একখানা চিঠি। তাতে লেখা,
মাননীয় মহাশয়, নিতান্ত অপারগ হইয়া আপনার কন্যাকে অপহরণ করিতে হইল। আমাদের শর্ত হইল, আজ রাত বারোটায় আপনি আপনার থানার তেরো নম্বর আসামি পল্টু ওরফে মৃগেন পাকড়াশিকে মুক্তি দিবেন। অন্যথায় আপনার কন্যার ভালমন্দের দায়িত্ব আমরা লইতে পারিব না। আমাদের প্রস্তাবে আপনি সম্মত হইলে আপনার সামনের বারান্দায় একটা লাল গামছা বা কাপড় টাঙাইয়া দিবেন।
প্রাণপতির আজ কী হয়েছে, তা তিনি নিজেই বুঝতে পারছিলেন। মাথাটা বেশ কাজ করছে। এ যেন ঠিক তিনি নন, অন্য কেউ। তিনি চট করে একখানা লাল রঙের গামছা বাইরের বারান্দায় টাঙিয়ে দিয়ে সকলের দিকে চেয়ে বললেন, “একটা লম্বাপানা টাক মাথার লোক, কটা চোখ, গায়ে একটা আলখাল্লার মতো পোশাক, তাকে খুঁজে বের করতে হবে। তাকে খুঁজে বের করা খুব জরুরি। এই কাণ্ডর মূলে সেই লোকটার হাত আছে।” সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল।
খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, জুলজুলে চোখ, রোগা চেহারা, লুঙ্গি আর কামিজ পরা একটা লোক এগিয়ে এসে বলল, “তাকে খুঁজছেন কেন বড়বাবু?”
“সে-ই যত নষ্টের গোড়া।”
উদ্ধব খটিক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নেড়ে বলে, “আজ্ঞে, তাঁকে কি কেউ খুঁজে পাবে হুজুর?”
“তার মানে? তুমি কি তাকে চেনো?”
উদ্ধব মাথা চুলকে বলে, “যার কথা বলছেন তার সঙ্গে একজনেরই মিল আছে হুজুর। তিনি বড় ভাল লোক।”
“কিন্তু লোকটা কোথায়, তাকে ধরে আনো।”
হরেন চাটুজ্যের মা মৃদুভাষিণী দেবী এগিয়ে এসে বললেন, “ও বাবা প্রাণপতি, তুমি কাকে খুঁজছ বলো তো?”
“সে একজন কটা চোখের ঢ্যাঙা লোক মাসিমা, মাথাজোড়া টাক, ফর্সা রং আর গায়ে আলখাল্লা গোছের পোশাক।”
“সে কী করেছে বাবা?”