“তার আমি কী জানি!”
ভুবন উঠে পড়ল। কুড়ুলটা কাঁধে ঝুলিয়ে বলল, “অষ্টপুরের থানাটা কোন দিকে বলো তো?”
ঘণ্টাপাগলা অবাক হয়ে বলে, “লাশের কথা কবুল করবে বুঝি! খুব ভাল, খুব ভাল। চলো, আমিই নিয়ে যাচ্ছি। তা কাকে মারলে বলো তো! নিশাপতি সাধুখাঁকে নাকি? নিশাপতি অতি পাজি লোক। তার পিতলের ঘটি চুরি করেছি বলে জুতোপেটা করেছিল আমাকে। উমেশ কর্মকারকে নয়তো! মেরে থাকলে কিন্তু খারাপ কয়রানি ভায়া। উমেশের গোয়ালঘর পরিষ্কার করতে রাজি হইনি বলে গরম লোহার ছ্যাকা দিয়েছিল। মোটে পাঁচ টাকা রেটে কি রাজি হওয়া যায় বাপু? গিরীন সামন্ত হবে কি? বেশ মুশকোমতো কালো বনমানুষের মতো চেহারা গো! বড়বড় দাঁত! তার বারান্দায় এক রাতে শুয়েছিলুম বলে কী হম্বিতম্বি! কান ধরে ওঠবোস অবধি করিয়েছিল। না হলে কি ধনপতি জোয়ারদার নাকি? ধনপতি হলে খুব ভাল হয়। গুন্ডার সর্দার। বিনি পয়সায় তার সাত জোড়া জুতো বুরুশ করে-করে আমার হাতে ব্যথা…”
প্রাণপতি খাসনবিশের আজ মেজাজ ভাল নেই। গতকাল সকালে সামনের বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলেন, ওই সময় তার মনটা ভারী ফুরফুরে থাকে। মাথায় উচ্চ চিন্তা আসতে থাকে।
তখন সবে সূর্য উঠি-উঠি করছে, গাছগাছালিতে বিস্তর পাখি ডাকছে, শরৎকাল আসি-আসি করছে বলে মিঠে হাওয়া দিচ্ছে, বাগানে ফোঁটা শিউলির গন্ধটাও আসছে খুব। গোরুর হাম্বা, কুকুরের ঘেউ ঘেউ যেন ভোরবেলাটাকে একেবারে হোল্লাই দিচ্ছিল। চা খেতে খেতে তিনি উচ্চ চিন্তায় উড়ে যাওয়ার জন্য তৈরিও হচ্ছিলেন। চিন্তার বিষয়টাও শানিয়ে রেখেছিলেন। একের ৬২
সঙ্গে এক যোগ করলে হয় দুই। তাই যদি হবে, তা হলে এই যে চারদিকে যা সব রয়েছে, বাড়িঘর, গাছপালা, হাঁস-মুরগি, গোরু বাছুর, রোদ-আকাশ এসব যোগ করলে যোগফল কী হবে। রোদের সঙ্গে হাওয়া যোগ দিলে কী দাঁড়ায়?
সবে ভাবনা শুরু করতে যাবেন, ঠিক এমন সময় দেখতে পেলেন ফটকের বাইরে একটা লোক দাঁড়িয়ে বাড়ির দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। লোকটা বেজায় লম্বা, মাথায় টাক, কটা চোখ, পরনে একটা আলখাল্লার মতো জিনিস।
তিনি হেঁকে বললেন, “কে ওখানে? কী চাই?”
লোকটা একটাও কথা না বলে পিছু ফিরে চলে গেল। একজন সেপাইকে ডেকে লোকটার খোঁজ করতে পাঠালেন। ঘণ্টা খানেক পর ফিরে এসে সে বলল, “আজ্ঞে বড়বাবু, কোথাও পাওয়া গেল না।”
সেই থেকে মেজাজটা খিঁচড়ে গেল। উচ্চ চিন্তায় উড়ি-উড়ি করেও উড়তে পারলেন না।
কিন্তু ব্যাপারটা সেখানেই শেষ হল না। সকালে বাজারে যাওয়ার সময় টের পেলেন, কেউ যেন তাঁর পিছু নিয়েছে। একবার চকিতে পিছু ফিরে যেন দাড়িগোঁফওলা একটা লোককে চট করে একটা গাছের আড়ালে গা ঢাকা দিতেও দেখলেন।
বাজার করতে করতেও সারাক্ষণ মনে হতে লাগল, তাকে কেউ নজরে রাখছে, তার গতিবিধি লক্ষ করছে। অথচ তিনি অষ্টপুরের বড়বাবু, বলতে গেলে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। এত সাহস কার যে, তার উপর নজর রাখে?
এতে হল কী, সারাদিন তার আর উচ্চ চিন্তা হল না।
উচ্চ চিন্তা না হলে প্রাণপতিবাবুর নানা রকম অসুবিধে হতে থাকে। অনিদ্রা হয়, হাই ওঠে, অরুচি হয়, নাক চুলকোয় এবং হাত-পা নিশপিশ করে। আজ সকালবেলায় কালকের মতোই পাখি ডাকছিল, শিউলির গন্ধ ছড়াচ্ছিল, গোরুর হাম্বা, কুকুরের ডাক কোনও কিছুরই অভাব ছিল না। কিন্তু প্রাণপতিবাবুর মনে হচ্ছিল, এমন বিটকেল সকাল আর দেখেননি, শিউলির কী বিচ্ছিরি গন্ধ, পাখিগুলো যে কেন এত চেঁচায় আর চা জিনিসটা যে কেন আহাম্মকরা খায়?
বাজারের দোকানিরা তাকে যথেষ্টই খাতির করে। ন্যায্য দামই নেয়, ওজনেও ঠকায় না। কিন্তু আজ বাজার করতে গিয়ে তার খুব ইচ্ছে করছিল, মাছওলা বিনোদকে একটা ঘুসি মারেন। কালুরামের মুদিখানায় ডাল আর সর্ষের তেল কেনার সময় তার খুব ইচ্ছে হল, কালুরামকে বেত মারতে মারতে থানায় নিয়ে হাজতে পুরে রাখেন। আর লাউ কেনার সময় সবজিওলা কেনারামকে বিনা কারণেই তিনি “গাধা’, ‘গোরু’ ও ‘রাসকেল’ বলে গালাগাল করে বসলেন। এবং করে মনে হল, ‘বেশ করেছি’। ওদের উচিত শিক্ষা হওয়া দরকার।
একটু বেলার দিকে যখন থানায় এসে বসলেন, তখন তাকে কেউই যেন ঠিক চিনতে পারছিল না। রোজকার যেই ভোলাভালা, আনমনা ভালমানুষের জায়গায় যেন দারোগার চেয়ারে একটা ভালুক বসে আছে। চোখদুটো ভাঁটার মতো চারদিকে ঘুরছে। কথায় কথায় রুলটা তুলে ঠাস করে টেবিলে ঘা মারছেন। কেউ কাছে ঘেঁষতে সাহস পাচ্ছে না।
ঠিক এই সময় ঘণ্টাপাগলা গ্যালগ্যালে হাসিমুখে ঘরে ঢুকে একটা সেলাম ঠুকে বলল, “গুড মর্নিং, বড়বাবু। ব্রিং এ মার্ডারার। এই আজ সকালেই ফস্টারসাহেবের বাড়ির কাছে একজনকে খুন করে এসেছে হুজুর। এই যে, একেবারে হাতেনাতে ধরে এনেছি… কই হে, এসো…”
ঘণ্টার একটু পিছনে যে লোকটা ঘরে ঢুকল সে দেড় মানুষ লম্বা, তেমনি পেল্লায় পেটানো চেহারা। কাঁধে লটকানো একটা কুড়ুল এবং তাতে বাস্তবিক রক্তের দাগ।
প্রাণপতি একটা হুংকার দিয়ে লাফিয়ে উঠলেন, “কাকে খুন করেছিস?”
লোকটা একটু হেসে হাত তুলে বরাভয় দেখিয়ে বলল, “ব্যস্ত হবেন না বড়বাবু। খুন-টুন করে আসিনি। পথে একটা কেউটে সাপের মুখে পড়ে গিয়েছিলাম, সেটাকেই মারতে হয়েছিল।”