ভারী হতাশ হয়ে অবনী বলে, “তা হলে কী উপায় বলুন তো!”
“ওই দেখো কাণ্ড! জামাইবাবু কি ঘেবড়ে গেলেন নাকি? আপনার খেল দেখব বলেই যে দোগাছি থেকে এত দূর ছুটে এলুম!”
অবনী আমতা-আমতা করে বলে, “সে তো বুঝলুম। কিন্তু আমার যে আর এই অষ্টপুর জায়গাটা মোটেই ভাল লাগছে না!”
“কেন, অষ্টপুর তো দিব্যি জায়গা!”
“অষ্টপুরের চেয়ে আমাদের খিজিরগঞ্জ অনেক ভাল জায়গা মশাই।”
“কেন জামাইবাবু, অষ্টপুরের চেয়ে খিজিরগঞ্জ ভাল কীসে?”
অবনী অনেক ভেবেও খিজিরগঞ্জের ভাল কিছু মনে করতে পারল না। শুধু বলল, “খিজিরগঞ্জের ভোটকচু খুব বিখ্যাত।”
লোকটা হাঃ হাঃ করে অট্টহাস্য হেসে বলে, “কচুঘেঁচুর কথাই যদি ওঠে জামাইবাবু, তা হলে বলি অষ্টপুরের মানকচুর কথা সাহেবরাও জানেন। জগদ্বিখ্যাত জিনিস। বছর দশেক আগে এত বড় একটা মানকচু তোলা হয়েছিল যে, সেই জায়গায় একটা সুড়ঙ্গ তৈরি হয়ে গিয়েছে। লোকে দেখতে আসে!”
৭. খেতখামারে কাজ করতে হয় ভুবনকে
খেতখামারে কাজ করতে হয় ভুবনকে। খালেবিলে ঘুরতে হয়। সুতরাং সাপখোপের সঙ্গে তার মেলাই দেখাসাক্ষাৎ হয়ে যায়। কিন্তু সাপ মারে না ভুবন। মারতে নেই। মা মনসার বাহন বলে কথা। আর ভগবানের দুনিয়ায় যা কিছু আছে, সবটাকেই বোধ হয় দরকার।
কিন্তু আজ সাপটাকে মারতে হল বলে ভুবনের ভারী খারাপ লাগছিল। পলু পাকড়াশির সন্ধানে কুঁকড়োহাটি থেকে খুব ভোরবেলাই বেরিয়ে পড়েছিল সে। মোটে দু’ মাইল রাস্তা চোখের পলকে পেরিয়ে অষ্টপুরে ঢোকার মুখেই ঘটনা। ভাল করে আলো ফোটেনি তখনও। একটা জঙ্গুলে রাস্তা দিয়ে পোড়োবাড়ি পেরিয়ে আসার মুখে আচমকাই পথ আটকে ফণা তুলল সাপটা। একটু হলেই ঠুকে দিত। বিশেষ ভাবনা-চিন্তা না করেই কুড়ুলটা চালিয়ে দিয়েছিল ভুবন। সাপটা প্রায় দু’ আধখানা হয়ে পাশের ঘাসজমিতে ছিটকে পড়ে কিছুক্ষণ কিলবিল করল খুব। তারপর আর নড়াচড়া নেই।
ভুবন তার মায়ের কাছে শুনেছে মা মনসার দোর ধরে তার জন্ম হয়েছিল। মায়ের তাই বারণ ছিল, “সাপ মারিস না বাবা। ওতে বড় পাপ হবে।”
ভুবনের তাই সাতসকালেই বড় মনস্তাপ হচ্ছিল। যে গনগনে রাগ নিয়ে কুড়ুল হাতে সে পলু পাকড়াশিকে নিকেশ করতে বেরিয়ে পড়েছিল, সেটা যেন দপ করে নিভে গেল। নিচু হয়ে সাপটাকে দেখল সে। বড়সড় কালকেউটে। ছোবল মারলে রক্ষে ছিল না। কিন্তু না মারলেও হত। গাঁয়ের মানুষ সে, ভালই জানে মাটিতে চাপড় মারলে বা হাততালি দিলে সাপ বড় একটা ছোবল-টোবল দেয় না, বরং পালায়। কিন্তু আজ মাথাটা বড় গরম হয়ে ছিল, হিতাহিত জ্ঞান ছিল না।
কোমরের গামছায় কপালের ঘাম মুছে ভুবন তাই পাশের একটা গাছতলায় বসল, পাশে রক্তমাখা কুড়ুল। মায়ের দিব্যি দেওয়া ছিল, সেটা আজ সকালে ভঙ্গ হল বলে বড্ড দমে গিয়েছে মনটা। গাছে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে মনটাকে বাগে আনার চেষ্টা করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে কে জানে।
হঠাৎ দেখতে পেল, সামনে একটা খুব ঢ্যাঙা চেহারার লোক দাঁড়িয়ে। তার মাথায় টাক, নাকটা বেজায় চোখা, কটা চোখ, দাড়িগোঁফ কামানো, গায়ে একটা আলখাল্লার মতো, আর হাতে একটা লম্বা ডান্ডায় লাগানো বুরুশ। বলল, “একটা সাপ মারলেই যদি এত মনস্তাপ হয়, তা হলে একটা মানুষ মারলে আরও কত মনস্তাপ হবে, তা ভেবেছ?”
ভুবনের ভাবনা-টাবনা বিশেষ আসে না, তবু তার মনে হল, লোকটা ঠিক কথাই বলছে। সে তবু মিনমিন করে বলে, “কিন্তু সে যে আমার ভাইটাকে মেরেছে।”
“তাই আর একটা ভাইকেও মারতে চাও?”
“তা হলে কী করব?”
“মনে রেখো, যাকে মারতে চাও তাকে প্রভু বড় ভালবাসেন।”
“প্রভু কে?”
“প্রভু যার কাছে যেমন, ঠিক তেমন। মা মনসা হয়ে প্রভু তোমার কাছেই রয়েছেন। আমি তার ভৃত্য।”
মুখে কার একটা গরম শ্বাস পড়ায় চটকা ভেঙে চেয়ে ভুবন দেখতে পেল, তার সামনে উবু হয়ে বসে একটা লোক জুলজুলে চোখে তাকে দেখছে। তার পরনে একটা হাফপ্যান্ট আর একটা ঢলঢলে জামা। সে চোখ চাইতেই বলল, “উরেব্বাস রে! তুমি তো দোতলা বাড়ির মতো বড় একটা লোক! ঘরদোরের মধ্যে আঁটো কী করে?”
ভুবন একটা হাই তুলে সোজা হয়ে বসল। জবাব দিল না।
লোকটা গলা এক পরদা নামিয়ে বলল, “তা লাশটা কোথায় লুকোলে বলো তো!”
“লাশ! কীসের লাশ?”
লোকটা খুব বুঝদারের মতো একটু খুক করে হেসে বলল, “ভাবছ, আমি রটিয়ে বেড়াব? আমাকে সে বান্দা পাওনি। আমার মুখ দিয়ে কখনও বেস কথা বেরোয় না বাপু। কথা চেপে রাখতে আমি খুব ওস্তাদ।”
“বটে!”
“তবে!নবকান্তবাবুর গাছ থেকে ট্যাঁপা আর নবু যে আটটা কাঁঠাল চুরি করেছিল, সে কথা কাউকে বলেছি, বলো! হাসু মণ্ডল যে দুর্গা পাইনকে আড়ালে ‘কুমড়োপটাশ’ বলে, সেটা কখনও ফাস করেছি। কি? তেজেনবাবুর যে লেজ আছে, তা আর কেউ না জানুক আমি তো জানি। কিন্তু গলা টিপে মেরে ফেললেও সে কথা কাউকে বলব না। বেশি কথা কী, প্রাণপতি দারোগা ফাঁসির আসামি বলে যাকে হাজতে বন্ধ করে রেখেছে, সে যে আসলে পল্টু পাকড়াশি নয়, মাধবগঞ্জের নবীন দাস, সে কথা আমি ছাড়া কাকপক্ষীও কখনও টের পায়নি। বুঝেছ? আরও পাকা কাজ চাও তো দশটা টাকা ফেলে দিয়ো, মুখে স্কু এঁটে যাবে। লাশের খবর কেউ পাবে না।”
ভুবন ছোট চোখ করে লোকটার দিকে চেয়ে বলল, “তা হলে পল্টু পাকড়াশি কোথায়?”