অবনী ঘোষাল শুকনো মুখে একটা ঢোক গিলে বলল, “কিন্তু পল্টু পাকড়াশি তো অষ্টপুরের ছেলে নয়! তা হলে অষ্টপুরের লোক রেগে যাচ্ছে কেন?”
“আজ্ঞে, সে কথাও উঠেছিল জামাইবাবু। দামোদর হাতি কথাটা তুলে বলেছিল, ‘পল্টু পাকড়াশি বহিরাগত, ফরেনার। সে ভূমিপুতুর নয়। তার জন্য অষ্টপুরের জামাইকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলা উচিত হবে কি না। তাতে গদাই মল্লিক জলদগম্ভীর গলায় খুব ভাবাবেগ দিয়ে বলতে লাগল, ‘ভাইসব, অপরাধ জগতে বহিরাগত বলে কিছু নেই। গুন্ডা ভারতবাসী, চোর ভারতবাসী, ডাকাত ভারতবাসী, খুনি ভারতবাসী আমার ভাই, আমার আত্মার আত্মীয়। তাদের অপমানে আমাদেরও অপমান। তাদের ব্যথা, তাদের বেদনা আমাদেরই ব্যথা ও বেদনা…’ওঃ জামাইবাবু, কী বলব আপনাকে, গদাইয়ের বক্তৃতা শুনে অনেকে চোখের জল চাপতে পারেনি। শেষে সভায় ঐকমত্য হল যে, অবনী ঘোষালকে প্রথমে হাটুরে প্রহার, তারপর জীয়ন্ত কবর দেওয়া হবে, যাতে এরকম অসামাজিক এবং অমানবিক কাজে নামবার আগে জনসাধারণ সতর্ক হয়।”
অবনী ঘোষাল কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে, “কিন্তু পল্টু পাকড়াশিকে মেরেছে তো পাবলিক, আমার কী করার ছিল বলুন!”
“আহা, সেসব আলোচনাও কি হয়নি জামাইবাবু! পশুপতি গুছাইত তো পষ্ট করেই বলল, অবনী ঘোষাল যদি জনতাকে খেপিয়ে না তুলত, তাদের উত্তেজিত করার জন্য ইন্ধন না ছড়াত, তা হলে এরকম নারকীয় ঘটনা ঘটতে পারত না। আপনারা জানেন অষ্টপুর একটি শান্তিপ্রিয় জায়গা, এখানে দারোগা পুলিশ পর্যন্ত আলস্যে সময় কাটায়। ওই যমতুল্য জামাইটি এসেই আজ অষ্টপুরের চরিত্র নষ্ট করেছে। ভাইসব, ওই অবনী ঘোষালের রক্তে হাত না রাঙালে আমাদের শান্তি নেই। ওঃ, তাই শুনে কী উল্লাস চারদিকে!”
জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে অবনী বলে, “আচ্ছা, আমার যে ভারী জলতেষ্টা পেয়েছে!”
“তার আর ভাবনা কী! এই যে আমার জলের বোতলটা নিয়ে ঢকঢক করে মেরে দিন।”
জল খেয়ে বোতলটা ফিরিয়ে দিয়ে অবনী বলে, “আচ্ছা, এখান থেকে হরিপুর যাওয়ার পরের বাসটা কখন ছাড়বে যেন!”
“বেলা তিনটের আগে নয়। কিন্তু জামাইবাবু, অষ্টপুরকে এইসব গুন্ডা বদমাশদের হাতে ছেড়ে দিয়ে আপনি কোথায় যাবেন? আর অষ্টপুরের জনগণই কি আপনাকে ছাড়বে ভেবেছেন? তারা যে আপনার মুখাপেক্ষী হয়েই আছে।”
অবনী সখেদে বলল, “অষ্টপুরে বিয়ে করাটাই আমার মস্ত ভুল হয়ে গিয়েছে দেখছি। এর চেয়ে বিষ্ণুপুরে বিয়ে করলে অনেক ভাল ছিল।”
“আজ্ঞে, ঠিকই বলেছেন। তবে কিনা অষ্টপুরে আপনার যা নাম হল, এমন ক’জনের ভাগ্যে হয় বলুন! এই তো পুলক মিত্তির বারোখানা যাত্রাপালা লিখেও তেমন নাম করতে পারল না, মদন মালো এত বড় পালোয়ান হয়ে তেমন সুখ্যাতি পেল না, প্রহ্লাদ প্রামাণিক আড়াইশো রসগোল্লা খেয়ে বিশ্বরেকর্ড করা সত্ত্বেও ক’জন তার নাম জানে বলুন। আর আপনার নাম এখন দশটা গাঁয়ের লোকের মুখে মুখে ফিরছে। বাঘা যতীন, ক্ষুদিরামের পরেই এখন আপনার সুখ্যাতি। তার উপর ধরুন, অষ্টপুরের গুন্ডা বদমাশরাও তো ছেড়ে কথা কওয়ার লোক নয়। তারা সব রাস্তাঘাট, অলিগলিতে নজর রেখেছে। এই যে একটু আগে মাথায় গামছা জড়ানো একটা লোক উত্তর দিকে হেঁটে গেল, আর তারপরেই যে বেঁটেমতো একজন ঝাঁকা মাথায় দক্ষিণ দিকে দুলকি চালে যাচ্ছিল, তাদের দেখে কিছু বুঝলেন?”
“আজ্ঞে না।”
“ওরা হল গে অষ্টপুরের নষ্ট লোকদের আড়কাঠি। আপনার উপর আড়ায়-আড়ায় নজর রাখছে। পালানোর উপক্রম হলেই…”
“ওরে বাবা! কিন্তু আমার মায়ের যে বড় অসুখ! আমার আজই রওনা হওয়া দরকার।”
“সে তো ঠিকই। বড়ই দুঃখের কথা। মায়ের অসুখ হলে তো রওনা হয়ে পড়াই দরকার। কিন্তু জামাইবাবু, আমি যেন কানাঘুষো শুনেছিলুম যে, গত বছরই আপনার মায়ের গুরুতর অসুখ হয়ে তিনি গঙ্গাযাত্রা করেছিলেন। কালাশৌচ পড়ে যাওয়ায় আপনার বিয়ে ছয়মাস পিছিয়ে এই গত আষাঢ়ে হয়েছে! কথাটা কি তা হলে গুজব?”
“অসুখটা ঠিক মায়ের নয় বটে, আমার এক মাসির। আমি তার ছেলের মতোই।”
“তা তো বটেই। মায়ের বদলে মাসির অসুখ হওয়াও খুব খারাপ। তা দেখুন, তিনটে দশের বাসটা যদি ধরতে পারেন।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। বরং পুলিশ পাহারা নিয়ে এই বাসটাই ধরে ফেলি। কী বলেন?”
“আজ্ঞে, পুলিশ পাহারাও নিতে পারেন। তবে কিনা অষ্টপুর থানার সেপাইদের তেমন বীরত্বের খ্যাতি নেই। বছর দশেক আগে রামভজন সিংহ নামে এক সেপাই ছিল। শোনা যায়, কালুডাকাত যখন নবকান্তবাবুর বাড়িতে ডাকাতি করতে এসেছিল, তখন ডাকাতি সেরে পালানোর সময় একজন ডাকাত একটু পিছিয়ে পড়ায় ওই রামভজন তাকে জাপটে ধরে। অষ্টপুর থানার শেষ বীর বলতে ওই রামভজন, তা সেও তো কবেই রিটায়ার করে দেশে চলে গিয়েছে।”
“ডাকাতটাকে ধরে কী করা হল?”
“ধরে রাখা যায়নি যে। সে রামভজনকে কাতুকুতু দিয়ে পালিয়ে যায়। প্রাণপতিবাবু তো গত পরশুদিনই তাঁর নিজের বউকে ভুল করে ‘বউদি’ বলে ডেকে ফেলেছিলেন। শুধু কি তাই? স্কুলের পুরস্কার বিতরণী সভায় একটা ফুটফুটে মেয়েকে দেখে থুতনি নেড়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘বাঃ খুকি, ভারী মিষ্টি দেখতে তো! নাম কী তোমার?’ বললে পেত্যয় যাবেন না, ওই খুকিটি প্রাণপতিবাবুর নিজেরই মেয়ে।”
“বলেন কী মশাই!”
“আরও শুনবেন? হেড কনস্টেবল ফটিক তবলা বাজিয়ে বেড়ায়, বক্রেশ্বরের হাতযশ হোমিয়োপ্যাথিতে, ছোট কনস্টেবল তন্ময় পাল কবিতা লেখে, নন্দগোপাল হালুই ঘুড়ি ওড়ানোয় চ্যাম্পিয়ন। এরা কেউ কখনও কোনও চোর-ডাকাত বা গুন্ডা-বদমাশকে ধরেনি, ঘাঁটাতেও যায়নি।”