তবে ঘণ্টার নামডাকও আছে। এই তো সেদিন দুপুরবেলা থানার বড়বাবু প্রাণপতি খাসনবিশ তাঁর অফিসে বসে আছেন। এমন সময় এক ভদ্রমহিলা হন্তদন্ত হয়ে ঢুকতেই প্রাণপতি সচকিত হয়ে উঠলেন। ভদ্রমহিলাকে তাঁর খুবই চেনা-চেনা লাগছিল। খাতির করে বললেন, “বসুন বউদি, বসুন।”
তখন কনস্টেবল ফটিক তাঁর কানে-কানে বলল, “বড়বাবু, ইনি আমাদের বউদি বটে, কিন্তু আপনার বউদি নন।”।
প্রাণপতি অবাক হয়ে বললেন, “কেন? কেন?”
তখন ফটিক বলল, “আপনার বউদি হওয়ায় এঁর কিছু অসুবিধে আছে। কারণ, ইনি আপনার বউ।”
তখন প্রাণপতি ভারী লজ্জিত হয়ে বললেন, “ওঃ হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই যেন চেনা-চেনা ঠেকছিল বটে।”
বিজুবউদি তখনই খুব রাগ করে বলেছিলেন, “তোমার চাইতে ঘণ্টাপাগলাও ভাল।”
কথাটা কানে আসায় ঘণ্টার ভারী দেমাক হয়েছিল। স্বয়ং দারোগাবাবুর সঙ্গে তার তুলনা হচ্ছে! ব্যাপারটা তো ফ্যালনা নয়!
দিঘি ছাড়িয়ে বাঁয়ে ফস্টারসাহেবের ভুতুড়ে বাড়ির দিকটার নীলকুঠির জঙ্গলে ঢুকে গোরুটাকে গোরুখোজা করতে করতে হঠাৎ দানোটার একেবারে মুখোমুখি পড়ে গেল ঘণ্টা। প্রথমে গাছতলায় মুখোমুখি লোকটাকে দেখে ঘণ্টা ইংরেজিতে “কে তুমি?” বলতে গিয়ে বলে ফেলেছিল “হোয়াই ইউ?” লোকটা অবশ্য জবাব দিল না। তখন ঘণ্টা দেখল, লোকটার চোখ বোজা। তারপর যা দেখল, তাতে তার হাতে-পায়ে খিল ধরার উপক্রম। লোকটা দাঁড়িয়ে নয়, ঠ্যাং ছড়িয়ে ঘাসমাটির উপর বসে গাছে হেলান দিয়ে ঘুমোচ্ছে। বসা অবস্থাতেই তার মাথাটা ঘণ্টার মাথার সমান-সমান। শুধু তাই নয়, তার পাশে একখানা রক্তমাখা কুড়ল।
৬. জামাইবাবু যে
“জামাইবাবু যে! নমস্কার, নমস্কার! কী সৌভাগ্য! কী সৌভাগ্য!”
পল্টু পাকড়াশিকে পাকড়াও করার জন্য সরকার বাহাদুর কোনও পুরস্কার ঘোষণা করেছে কি না সেটা জানতে থানায় এসেছিল অবনী ঘোষাল। করেনি শুনে ভারী হতাশ হয়ে থানা থেকে বেরোবার মুখেই অবনী ঘোষালের পথ আটকাল একটা বেশ হাসিখুশি আহ্লাদি চেহারার উটকো লোক। অবনীর মেজাজটা খিঁচড়ে আছে। এই নিয়ে চার-চারটে দিন কেটে গেল, সরকারের দিক থেকে কোনও সাড়াশব্দই নেই! এরকম চললে মোটরবাইকটা কেনার কী হবে তা ভেবে পাচ্ছিল না অবনী। এই পোড়া দেশে ভাল কাজের কি কোনও দামই নেই?
ঠিক এই সময় লোকটা গ্যালগ্যালে মুখে তার পথ আটকে দাঁড়াতেই অবনী বিরক্ত হয়ে বলে, “হ্যাঁ হ্যাঁ, নমস্কার। আমি এখন একটু ব্যস্ত আছি মশাই!”
“তা তো ব্যস্ত থাকারই কথা! চারদিকে যে আপনাকে নিয়ে ধন্যি-ধন্যি হচ্ছে জামাইবাবু! লোকে তো শতমুখে আপনার সুখ্যাতি করে বেড়াচ্ছে! সেদিন তো গাবতলির হাটে শুনলুম, এক কবিয়াল গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে আপনাকে নিয়ে গান বেঁধে গাইছে, আর লোকে শুনছেও ভিড় করে। অষ্টপুরে অবতীর্ণ মোদের জামাই, সবারে ভরসা দিল আর ভয় নাই…”।
অবনী পুলকিত হয়ে বলে, “তাই নাকি?”
“তবে? আমি তো আপনার দর্শন পাব বলে সেই দোগাছি থেকে আসছি।”
“বটে!”
“তা জামাইবাবু, অষ্টপুরের লোকেরা আপনাকে সংবর্ধনা টংবর্ধনা দিচ্ছে না?”
“না হে বাপু, সেসব লক্ষণ তো কিছু দেখছি না!”
“এঃ, এটা তো ভারী অন্যায় কথা! প্রাণ হাতে করে আপনি যে অষ্টপুরের অত বড় একটা খুনিয়ার সঙ্গে লড়াই করলেন, তার কি একটা দাম নেই? কৃতজ্ঞতা বলেও তো একটা কথা আছে, নাকি?”
“সে তো বটেই।”
লোকটা গলা আরও দু’ পরদা নামিয়ে বলল, “তবে কি জানেন জামাইবাবু, অষ্টপুরে গিজগিজ করছে খারাপ লোক। খুনে, গুন্ডা, পকেটমার, চোর, ডাকাত, কেপমার একেবারে ছয়লাপ। এ তো সবে শুরু।”
অবনী একটু থতমত খেয়ে বলে, “না-না, আমি আর অষ্টপুরের উপকার করতে পারব না মশাই, আমার কাজকর্ম পড়ে আছে।”
লোকটা গম্ভীর হয়ে বলে, “আপনি না চাইলেই তো হবে না জামাইবাবু, চোর-গুন্ডা-বদমাশরা সেকথা শুনবে কেন? তাদেরও তো একটা প্রেস্টিজ আছে!”
“তার মানে?”
লোকটা গলা আরও এক পরদা নামিয়ে বলে, “আজ্ঞে, সেই খবর পেয়েই তো আসা।”
“খবর! কীসের খবর মশাই?”
“পরশু রাত্তিরে যে শ্মশানের পাশের আমবাগানে বিরাট মিটিং হয়ে গেল! জোর বক্তৃতা হল মশাই, শুনলে গা গরম হয়ে যায়।”
অবনী ঘোষাল একটু ফ্যাকাসে হয়ে গিয়ে বলল, “তা তারা কী নিয়ে বক্তৃতা করছিল?”
“আজ্ঞে, আপনাকে নিয়েই। তাদের আঁতে বড্ড লেগেছে কিনা। একজন নিরীহ চোরকে ওরকম ভাবে পেটানোয় তারা বেজায় চটে গিয়েছে। নাটা শিট তো বেশ জবরদস্ত বাগ্মী। বলছিল, একজন নবীন প্রতিভা, একজন উদীয়মান শিল্পীর উত্থানকে এভাবে থামিয়ে দেওয়া শুধু অন্যায় নয়, মহাপাপ। কত বড় একটা সম্ভাবনার অকালমৃত্যু ঘটতে যাচ্ছিল, তা ভেবে আমাদের আশঙ্কা হয়। এই ঘটনার পিছনে নাটের গুরু হল শ্রীনিবাস আচার্যির ছোট জামাই মহাপাষণ্ড, কুলাঙ্গার, কাপুরুষ এবং অহংকারী অবনী ঘোষাল। ভাইসব, এই অবনী ঘোষাল দেশ ও দশের শত্রু, নরঘাতক, রক্তলোলুপ, বিশ্বাসঘাতক এবং মহাপাপী। পল্টু পাকড়াশির গণধোলাইয়ের পিছনে শুধু এর নোংরা হাতই ছিল না, এই অবনী ঘোষাল আবার এই অপকর্মের জন্য সরকার বাহাদুরের পুরস্কার পাওয়ার জন্যও ঘোরাঘুরি করছে। আপনাদের কাছে আজ আমার বিনীত আবেদন, অবনী ঘোষালকে এই অষ্টপুরের মাটিতেই কবর দিন। সে যেন আর অষ্টপুরের সীমানা ডিঙোতে না পারে। ওঃ, এসব শুনে যা হাততালি পড়ল না জামাইবাবু যে, অত রাতেও কাকগুলো কা কা করে ভয়ে বাসা ছেড়ে উড়ে পড়েছিল।”