“কী যে বলেন ঠাকুমা, পেরেক ওপড়ালে আর যিশুবাবার থাকে কী? পেরেক না হলে কি যিশুঠাকুরকে চেনা যায়?”
মৃদুভাষিণী ফঁৎ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, “হ্যাঁ রে উদ্ধব, লোকে বলে তুই নাকি চোর?”
উদ্ধব মাথা চুলকোতে চুলকোতে সেঁতো হাসি হেসে বলে, “এই প্রাতঃকালটায় দিব্যি তো ঠাকুর-দেবতার কথা হচ্ছিল ঠাকুমা, হঠাৎ আবার ওসব কথা কেন?”
“লোকের কাছে শুনি তোকে নাকি হাতকড়া পরালে চোখের পলকে খুলে ফেলিস, গারদে পুরলে এক লহমায় তালা খুলে পালিয়ে যাস। হয়রান হয়ে হয়ে নাকি শেষ পর্যন্ত প্রাণপতি দারোগা হাল ছেড়ে দিয়েছে!”
“লোকের কথা ধরবেন না ঠাকুমা। তারা সব বাড়িয়ে বলে।”
“স্বপনে কী দেখলুম জানিস বাবা! ওই যে ছোঁড়াটাকে হাটুরে মার দিয়ে সবাই আধমরা করে তারপর ফাটকে পুরে রেখেছে, ওর জন্য যিশুবাবার বড় কষ্ট। তা বাপু, তোর যদি এতই হাতযশ, তা হলে ছোঁড়াটাকে চুপিচুপি বের করে দে না বাবা। পালিয়ে বাঁচুক।”
উদ্ধব মাথা নেড়ে বলে, “লাভ নেই গো ঠাকুমা, ছোঁড়া ফাঁসির আসামি। সদর থেকে পুলিশের দল আসছে নিয়ে যেতে। ফাঁসিতে ঝোলাবে। ছেড়ে দিলেও পালাতে পারবে না। ছোঁড়া তেমন পাকাঁপোক্ত মানুষ নয় কিনা।”
“আহা, ছোঁড়ার মা না জানি কত কান্নাকাটি করছে। দেখ না বাবা কিছু করতে পারিস কি না।”
৫. নাকের ইংরেজি যে নোজ
নাকের ইংরেজি যে নোজ এটা ঘণ্টাপাগলা জানে। সে মাথা, কান, চোখ, হাত, পা, এমনকী পেটের ইংরেজিও জানে। বয়, গার্ল, গুড মর্নিং, গুড নাইট, থ্যাঙ্ক ইউ এসব ধরলে জানে সে মেলাই। আর কয়েকটা শিখতে পারলেই ইংরেজিটা সড়গড় হয়ে যায়। কিন্তু মুশকিল হল, শেখায় কে? বলাইমাস্টারকে ধরেছিল ঘণ্টা, কিন্তু বলাইমাস্টার আঁতকে উঠে বলল, “তোকে ইংরেজি শেখাব, অত বিদ্যে আমার পেটে নেই।”
কিন্তু ইংরেজিটা জানলে ভারী সুবিধেই হয় ঘণ্টার। এই তো সেদিন বিজুবউদিকে গিয়ে ফটাফট ইংরেজি শুনিয়ে দিয়েছিল ঘণ্টা। তাতে বউদি মুখে আঁচল চাপা দিয়ে খুব হেসেছিল বটে, কিন্তু একখানার বদলে সেদিন দু-দু’খানা গরম আটার রুটি আর এক খাবলা আলুচচ্চড়ি দিয়েছিল। ইংরেজির খাতিরই আলাদা।
ইংরেজি অক্ষরের ছিরিছাঁদও ভারী পছন্দ ঘণ্টার। যেন সারি সারি টেবিল, চেয়ার, পিরিচ, চামচ, কাঁটাচামচ, টুপি, পাতলুন সব সাজানো। আজ সকালে বনমালী পোদ্দার তাকে একটা ইংরেজি কাগজের ঠোঙায় একঠোঙা মুড়ি আর বাতাসা দিয়েছিল। চৌপথীর ধারে কাঁঠালগাছের তলায় বসে মুড়িটা খেয়ে ঠোঙাটা নিয়ে পড়েছিল ঘণ্টা। অক্ষরগুলো মুগ্ধ হয়ে দেখছিল সে। বাহ্যজ্ঞান নেই।
ঠিক এই সময়ে ভজন ভশ্চায এসে ধরে পড়ল, “ও বাবা ঘণ্টা, দুটো টাকা দেব’খন, আমার গোরুটা খুঁজে এনে দে। হাটখোলার মাঠে বাঁধা ছিল, খোটা উপড়ে পালিয়েছে।”
ঘণ্টা গম্ভীর হয়ে বলল, “আমার সময় নেই পণ্ডিতমশাই, আমি এখন লেখাপড়া করছি।”
“ওরে সে হবে’খন। তোর লেখাপড়া আটকায় কে? দুইয়ের জায়গায় না হয় তিনটে টাকাই পাবি বাবা। খুঁজে আন, নইলে কে কোথায় ধরে নিয়ে খোঁয়াড়ে দিয়ে দেবে! আমার মাজায় যে বড্ড ব্যথা রে বাবা!”
ভারী বিরক্ত হয়ে ঘন্টা বলে, “এরকম করলে তো চলে না মশাই, আমার লেখাপড়ায় যে বড্ড ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে?”
“ইংরেজির কথা কইছিস তো। ওরে, সে তো কবেই তোর ট্যাকে গোঁজা হয়ে গিয়েছে। এই তো সেদিন বিজুবউমা বলছিল, তুই এমন ইংরেজি বলেছিলি যে, কোলের খোকাটা পর্যন্ত ভয়ে কেঁদে উঠেছিল। ইংরেজিতে তোকে আটকায় কে?”
দিনকাল ভাল নয়। বাজারটাও খারাপ পড়েছে। এ বাজারে তিনটে টাকাও তো কম কথা নয়। তাই ঠোঙাটা ভাঁজ করে পকেটে রেখে উঠে পড়ল ঘণ্টা। ভশ্চাযমশাইয়ের গোরুটা তার পক্ষে বড্ডই পয়া। মাঝে-মাঝেই খোঁটা উপড়ে পালায়। ভাযমশাইয়ের মাজার ব্যথার দরুন গোরু বাবদ ঘণ্টার একটু আয়পয় হয়। গোরু খুঁজতে তার কিছু খারাপ লাগে না। পাঁচজনের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয়, কথাবার্তা হয়, গাঁ-টাও একটু চক্কর মেরে আসা হয়।
হরিশরণ চৌবের আখড়ার ধারে একটু দাঁড়িয়ে গেল ঘণ্টা। “গুড মর্নিং চৌবেজি!”
হরিশরণ উঠোনে খাঁটিয়ায় বসে ঘোলের শরবত খাচ্ছিল। নিমীলিত চোখে তার দিকে চেয়ে বলল, “অংরেজি বলবি তো খোপড়ি খুলে লিব।”
একগাল হেসে ঘণ্টা বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ।”
হরেন চাটুজ্যে বাজার নিয়ে ফিরছিলেন, দেখা হতেই ঘণ্টা খুব বিনয়ের সঙ্গেই প্রশ্ন করল, “হাউ ডু? হাউ ডু?”
হরেন চাটুজ্যে ম্লান মুখে মাথা নেড়ে বললেন, “না রে, হাডুডু সেই বয়সকালে খেলতুম বটে, এখন হাঁটুর ব্যথায় যে বড্ড কাবু হয়ে পড়েছি বাপ।”
“থ্যাঙ্ক ইউ!” বলে ঘণ্টা গটগট করে এগিয়ে যায়।
স্কুলের অঙ্কের মাস্টারমশাই জ্ঞানবাবু হন্তদন্ত হয়ে টিউশনি সেরে বাড়ি ফিরছিলেন, ঘণ্টা তাঁর সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “কাম ইন! কাম ইন!”
জ্ঞানবাবু বিরক্ত হয়ে রোষকষায়িত লোচনে তার দিকে চেয়ে বললেন, “হাতে বেতটা থাকলে এখন ঘা কতক দিতুম, বুঝলি! এটা কি তোর বৈঠকখানা যে, বড় অ্যাপ্যায়ন করছিস?”
“গুড বাই!” বলে ঘণ্টা এগোতে থাকে।
গোরু খোঁজার মজাটাই এইখানে। কত লোকের সঙ্গে দেখা হয়ে যাচ্ছে। তবে ইংরেজিটা যে সবাই বোঝে তা নয়। গাঁয়ের লোক তো, বুঝবে কী করে। এই তো সেদিন মৃদুভাষিণী দিদিমাকে গিয়ে ঘণ্টা বলেছিল, “একটু লেগডাস্ট দিন।” তা দিদিমা কী বুঝতে কী বুঝে ‘ওম্মা গো, হতচ্ছাড়াটা বলে কী!’ বলে এমন চেঁচালেন যে ঘণ্টাকে পালিয়ে আসতে হয়।