গোখরো সাপের সঙ্গে বিশু গায়েনের একটু তফাতও আছে। সাপ জাতটার বুদ্ধি নেই। তাই কখনও পোষ মানে না, স্মৃতি বলে কিছু কাজও করে না। কিন্তু বিশু বুদ্ধিমান। সে যা করবে, তাতে নাটুকেপনা থাকবে না। হাল্লাচিল্লা বা হাঙ্গামা থাকবে না, নিঃশব্দে কাজ হয়ে যাবে।
মোটরবাইকের মুখ ঘুরিয়ে বিশু অষ্টপুর রওনা হয়ে পড়ল।
অষ্টপুরের হরেন চাটুজ্যের মা মৃদুভাষিণী দেবী ভোররাতে স্বপ্ন দেখলেন, যিশুবাবার হাত আর পায়ের ক্ষতস্থান থেকে নতুন করে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। প্রণাম করে উঠেই এই দৃশ্য দেখে তিনি “ও মাগো,” বলে আর্তনাদ করে তাড়াতাড়ি বেদিতে উঠে আঁচল দিয়ে ক্ষতস্থান মুছিয়ে দিতে দিতে বললেন, “পেরেকগুলো এবার খুলে নিলেই তো হয় বাবা! এতদিন হয়ে গিয়েছে, এখনও পেরেকগুলো আছে কেন বলো তো?”
যিশুবাবা ভারী সুন্দর করে হেসে বললেন, “ও কি আজকের পেরেক রে! যতবার খুলবি, ততবারই মানুষ ফের পেরেকে গেঁথে দেবে আমায়। আমার ক্ষত তো সারবার নয়।”
“কেন বাবা, কেন এত কষ্ট তোমার?”
“আমার কোনও কষ্ট নেই। মানুষের কষ্টই পেরেক হয়ে আমাকে কষ্ট দেয়। ওই যে ছেলেটাকে ওরা কত মারল, সব মার এসে লাগল আমার গায়ে। জুড়োই কী করে বল তো?”
“তাই তো বাবা! মানুষের কষ্টই তো তোমার কষ্ট। ছেলেটাকে বড্ড মেরেছিল ওরা। মানুষের কি আর মায়াদয়া আছে!”
গির্জার পাঁচধাপ সিঁড়ি, তারপর একটু বাঁধানো জায়গা, সেটা পেরিয়ে দরজা। ওই দরজার বাইরেই শুয়ে ছিল উদ্ধব খটিক। শোওয়ার পক্ষে দিব্যি জায়গা। উপরে ছাউনি আছে, বৃষ্টি-বাদলায় কষ্ট নেই।
ভোরবেলা একজন উটকো লোককে দরজা আটকে শুয়ে থাকতে দেখে মৃদুভাষিণী অবাক আর বিরক্ত হয়ে বললেন, “কে রে অলপ্পেয়ে লক্ষ্মীছাড়া! দরজা আটকে শুয়ে আছিস? এটা কি জমিদারি পেয়েছিস হতভাগা? মুলুকে আর কোথাও শোওয়ার জায়গা জুটল না তোর?”
উদ্ধব আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে বলল, “আমার জন্য কে আর বিছানা পেতে রেখেছে বলুন! হা গো ঠাকুমা, লোকে যে বলে আপনি যিশু ভজনা করে খিরিস্তান হয়েছেন, সে কি সত্যি?”
“হলে হয়েছি, তাতে তোদের কী রে মুখপোড়া? বেশ করব খিরিস্তান হব, জুতোমোজা পরব, পাউরুটি খাব। তাতে তোর গায়ে ফোঁসকা পড়ে কেন? এখন পথ ছাড় তো বাপু, ভিতরে আমার কাজ আছে।”
“হুঁটপাট করা কি ঠিক হচ্ছে ঠাকুমা, ভিতরে ঝটপাট হচ্ছে যে!”
মৃদুভাষিণীর একগাল মাছি! বলে কী রে ছোঁড়া!
“গির্জায় আবার ঝটপাট দেবে কে? কার গরজ? কার মাথাব্যথা?”
উদ্ধব মাথা নেড়ে বলে, “তা জানি না, তবে রোজ সকালে গির্জার ভিতরে ঝটপাটের আওয়াজ শুনতে পাই।”
মৃদুভাষিণী থমকালেন, তাই তো! গির্জাটা সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কী করে থাকে, তা তো তিনি কখনও ভেবে দেখেননি। তিনি বললেন, “তা হ্যাঁ রে উদ্ধব, ঝটপাট কে দেয়, তা উঁকি মেরে দেখিসনি?”
উদ্ধব ফের মাথা নেড়ে বলে, “না ঠাকুমা, ওসব অশৈলী কাণ্ড। কাজ কী ওদের ঘাঁটিয়ে? মাঠে-ঘাটে, আনাচেকানাচে পড়ে থাকতে হয় আমাদের, কত অশৈলী কাণ্ডই চোখে পড়ে। কিন্তু ঘটাতে যাই না। যা হচ্ছে হোক, কাজ কী আমার খতেন নেওয়ার, না কী বলুন!”
মৃদুভাষিণী চিন্তিত মুখে বলেন, “তা তো বুঝলুম বাছা, কিন্তু আমার যে একটু কাজ ছিল।”
“এত ভোরে কী কাজ গো ঠাকুমা, আপনি তো মোমবাতি জ্বালাতে সেই সন্ধেবেলাটিতে আসেন!”
“ভোররাতে একটা খারাপ স্বপন দেখেছি রে বাপু, যিশুবাবার হাত-পায়ের ক্ষত দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। তাই বড় দুশ্চিন্তা হল, ভাবলুম সত্যি কিনা গিয়ে দেখে আসি।”
উদ্ধব কিছুক্ষণ হাঁ করে থেকে বলল, “তাই আপনার হাতে ডেটলের শিশি, তুলো আর গজ দেখছি বটে! এঃ হেঃ, লোকে যে হাসবে ঠাকুমা! পাথরের যিশুর গা থেকে রক্ত বেরোবে কী গো! তবে আপনার ভক্তি আছে বটে। যিশুবাবাকে আপনি বড্ড ভালবাসেন দেখছি।”
“তা সত্যি। যিশুবাবাকে কেমন গোপালঠাকুরের মতো লাগে রে।”
“ও যিশুই বলুন আর গোপালঠাকুরই বলুন, মা কালীর কাছে কেউ লাগে না। যিশুবাবার ধরনধারণ তো মোটেই পছন্দ হয় না আমার, মেনিমুখো মিনমিনে পুরুষ, ধরেবেঁধে নিয়ে পেরেকে গেথে দিল আর উনিও অমনি গা এলিয়ে ঝুলে রইলেন! আর শিষ্যগুলোই বা কেমন ধারা, বাবা বারণ করল বলেই বাবাকে রক্ষে করতে কেউ এগোলি না! গোপালঠাকুরের কথাও আর কবেন না, সারাটা জীবন তো বাঁশি বাজিয়ে আর ফস্টিনস্টি করেই কাটিয়ে দিলেন, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে একটা তিরও ছোড়েননি। আর মা কালীকে দেখুন, কচাকচ মুন্ডু কেটে অসুরব্যাটাদের কেমন সবক শেখাচ্ছেন! দেখলে ভয়ও হয়, ভক্তিও হয়।”
“দূর পোড়ারমুখো, ঠাকুর-দেবতা নিয়ে কি ওসব বলতে আছে! আমাদের কালী ভাল, গোপালও ভাল, যিশুও ভাল। এ্যা রে, দেওয়ালের পেরেকে ঝোলানো চাবিটা দিয়ে দরজার তালাটা খুলবি তো! বসে আছিস কেন হাঁ করে? সৃষ্টির কাজ ফেলে এসেছি যে!”
শশব্যস্তে উঠে দরজায় কান পেতে উদ্ধব খানিকক্ষণ শুনে নিয়ে বলল, “ঝাড়পোঁছের শব্দ বন্ধ হয়েছে।”
তালাটা খুলে দরজা হাট করে দিয়ে বলল, “এবার যান ঠাকুমা।”
ভিতরে ঢুকে দেখা গেল যিশুবাবার মূর্তি যেমন কে তেমনই আছে। তবু মৃদুভাষিণী ভারী মায়াভরে পা আর হাতের ক্ষতস্থানগুলো তুলো দিয়ে পুঁছে দিলেন। চোখে জল আসছিল, মৃদু স্বরে বললেন, “তোমার বড় কষ্ট বাবা। ইচ্ছে হয় পেরেকগুলো উপড়ে ফেলে দিই।”