- বইয়ের নামঃ অষ্টপুরের বৃত্তান্ত
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ অদ্ভুতুড়ে সিরিজ
১. নগেন পাকড়াশি
অষ্টপুরের বৃত্তান্ত – অদ্ভুতুড়ে সিরিজ – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
নগেন পাকড়াশি তাকে একখানা নতুন সাইকেল, একজোড়া নতুন বাহারি জুতো, একখানা ঝকমকে হাতঘড়ি আর নগদ দশ হাজার টাকা আগাম দিয়েছিল, আর কাজ হয়ে গেলে আরও পাঁচ লাখ টাকার কড়ার। এ ছাড়াও, পাকড়াশির কাছে তার জমি বাড়ি বাঁধা দেওয়ার যেসব কাগজপত্র ছিল, তাও ফেরত দিয়েছিল। বলেছিল, “এই কাজটুকু করে দে বাবা, তোকে রাজা করে দেব।”
তা রাজাগজা বলেই নিজেকে মনে হয়েছিল নবীনের। পাকড়াশির খাজাঞ্চি ভোলারাম একদিন এসে তাকে সব জলের মতো বুঝিয়ে দিল। বলল, “কোনও বিপদ-আপদ নেই রে বাপু, জেলখানায় শুয়ে-বসে কয়েকটা বছর আরামসে কাটিয়ে দেওয়া, দোবেলা খাওয়ার চিন্তা নেই। বিনি মাগনা মুফতে সকালে রুটি গুড়, দুপুরে মাছ-ভাত, রাতে রুটি-মাংস। চোদ্দো বছর মেয়াদ বটে, কিন্তু বছরে ছ’ মাস করে মেয়াদ কমে যায়। হরেদরে তোর ওই বড়জোর সাত-আট বছর মেয়াদ খাটতে হবে। বেরিয়ে এলেই নগদ পাঁচ লাখ টাকা, বুঝলি?”
নবীন ঘাড় নেড়ে বলল, “বুঝেছি।”
“তোকে তো আমার হিংসেই হচ্ছে রে। এমন সুযোগ যদি আমি পেতুম, তা হলে বর্তে যেতুম। কিন্তু কপাল বটে তোর! কোন ভাগ্যে যে তোর চেহারাখানা হুবহু পল্টুর মতো হল, কে জানে বাবা। আমার যদি তোর মতো একটা ছেলে থাকত, আর পল্টুর মতো দেখতে হত, তা হলে তো কেল্লাই মেরে দিতুম রে।”
নবীনের ইদানীং দিনকাল ভাল যাচ্ছিল না। জমি-বাড়ি বাঁধা, ধারকর্জও রয়েছে মেলাই, দোকানে বাকিও পড়ে আছে। কাজেই নগেন পাকড়াশির প্রস্তাবটা এল যেন শাপে বর।
দশ হাজার টাকা পেয়ে সে ধারকর্জ কিছু শোধ করে দিল। তারপর শহরে গিয়ে ভাল রেস্টুরেন্টে ঢুকে গান্ডেপিন্ডে মাংস, পোলাও, রাবড়ি আর সন্দেশ সাঁটাল। সাইকেলে করে গা থেকে শহর বার কয়েক চক্কর দিল রোজ। আর ঘনঘন ঘড়ি দেখার কী ঘটা! টাইম দেখে-দেখে আর আশ মেটে না।
মাধবগঞ্জে কুচুটে লোকের অভাব নেই। নবীনের এমন ধাঁ-উন্নতি দেখে অনেকেরই চোখ টাটাল। উমেশ পরামানিক তো একদিন ডেকে দাওয়ায় বসিয়ে ভারী মিষ্টি-মিষ্টি করে বলল, “জানি বাছা, তোর অবস্থা তেমন ভাল নয়। জমি-বাড়ি বাঁধা আছে। তা বলে কি শেষে চুরিতে নাম লেখালি? তোর বাপ শত কষ্টেও তো কোনওদিন অসৎ পথে পা বাড়ায়নি! পীতাম্বর দাসের ছেলে হয়ে তুই কিনা শেষে…?”
মুশকিল হল, লোকের কাছে গোটা ব্যাপারটা তো আর খোলসা করে বলা যায় না। এ যে চুরির জিনিস নয়, রীতিমতো মজুরি, তা বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না।
মনোরঞ্জন চাটুজ্যে একদিন ভারী অবাক হয়ে বলল, “হ্যাঁ রে নবে, চাকরি পেয়েছিস নাকি? আজকাল ঘড়ি ধরে চলাফেরা করছিস দেখছি!”
নবীন মরমে মরে গেল। মনোজ্যাঠাকে গুহ্য কথাটা বলা যায় যে। হাটখোলার কাছে এক দুপুরে তাকে ধরল ল্যাংড়া মানিক। একখানা লম্বা লাঠি আচমকা তার চলন্ত সাইকেলের চাকায় ঢুকিয়ে দিতেই সে সাইকেল উলটে চিৎপটাং। মানিক মস্তান একটু খুঁড়িয়ে এসে তার গলায় একখানা গামছা পেঁচিয়ে ফাঁস দিয়ে দাঁড় করিয়ে বলল, “এই যে চাঁদবদন, বলো তো বাপু, টু পাইস আসছে কোথা থেকে?”
গরিবের দুটো পয়সা হলে কেন যে লোকের চোখ টাটায়, তা কে জানে বাবা। নবীন চি চি করে বলল, “খেটেখুটে ন্যায্য রোজগারে কেনা মশাই, চুরি-ডাকাতির জিনিস নয়।”
“বটে!” বলে মানিক তার পকেট হাতড়ে শত খানেক টাকা পেয়ে তাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, “রোজগারপাতি তো খুব ভাল জিনিস রে! মাঝে-মাঝে একটু পেন্নামি দিয়ে যাস, তা হলে আর কেউ কোনও কথা তুলবে না। যাঃ, তোকে আজকের মতো ছেড়ে দিলুম।”
শুধু এতেই শেষ নয়। এক রাত্তিরে খুব বৃষ্টি নেমেছে। ঠান্ডা পেয়ে নবীন নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছিল নিজের ঘরে। হঠাৎ দমকা হাওয়া গায়ে লাগায় ঘুমের চটকা ভেঙে যেতেই সে দেখতে পেল, ঘরের দরজাটা হাট করে খোলা, হাওয়ায় কপাট দুটো আছাড়ি-পিছাড়ি খাচ্ছে। আর-একটা লোক তার সাইকেলখানা নিয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। বিপদ বুঝে নবীন লাফ দিয়ে পড়ে লোকটাকে সাপটে ধরল। লোকটা একটা মোচড় দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সাইকেলখানা ফেলেই পালিয়ে গেল।
নবীনের আর ঘুম হল না। বাকি রাতটুকু বসে ভাবল, এরকম হলে সে বড় বেকায়দায় পড়ে যাবে। টাকাপয়সা বা জিনিসপত্র সামলে রাখার বিদ্যে তার জানা নেই। সুতরাং বড়লোক হলেও তার সবই অন্যেরা কেড়েকুড়ে নেবে।
মনস্থির করে সে সকালেই গিয়ে নগেন পাকড়াশির গদিতে হাজির হয়ে সাইকেল, ঘড়ি, জুতো আর খরচ না-হওয়া সাতশো সাতান্ন টাকা ফেরত দিয়ে বলল, “কাজটা আমি পারব না কর্তা। টাকার গন্ধ পেয়েই চারদিকে নানা কথা উঠছে, অত্যাচারও শুরু হয়েছে। আমাকে আপনি রেহাই দিন।”
একথা শুনে নগেন আর্তনাদ করে উঠল, “পারবি না মানে! সব বন্দোবস্ত যে করে ফেলেছি! কম টাকা গচ্চা যাচ্ছে আমার! ছেলেটা মাথা গরম করে দু-দুটো খুন করে ফেলায় হয়রানির চূড়ান্ত। তার মধ্যে তুই এখন ব্যাক মারছিস!”
নগেনের পোষা গুন্ডাদের সর্দার হল চণ্ডীচরণ। তার পেল্লায় চেহারা। কাক করে এসে নবীনের ঘাড়টা ধরে নেংটি ইঁদুরের মতো শূন্যে ঝুলিয়ে বলল, “একটা রদ্দায় মাথা ভেঙে দিতে পারি, তা জানিস?”