দু’জনের ঝগড়া চরমে উঠেছে। হরমোহিনী লেপটেপ সরিয়ে ফেলে রীতিমত টানটান হয়ে বসেছেন তাঁর প্রকাণ্ড খাটের বিছানার ওপর। মোক্ষদাও আংরা জ্বালা মেটে হাঁড়িটা সরিয়ে সেঁক দেওয়ার ফ্লানেলের ভাঁজ করা কাপড়গুলো ফেলে তৈরি হয়ে বসেছে।
এমন সময় ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে রামলাল ঘরে ঢুকে পড়লেন। “ঠাকুমা!”
নাতিপুতিদের কাছে হরমোহিনী ভারি নরম। দেখলেই মেজাজ ঠাণ্ডা হয়ে যায়। একগাল হেসে বললেন, “আয় দাদা, আয়। হাঁফাচ্ছিস কেন ভাই?”
“সে অনেক কথা ঠাকুমা। শুধু হাঁফাচ্ছিই না গো, ল্যাংচাচ্ছিও। দেখছ না, পায়ের পাতায় কেমন রগ টানা দিয়েছে!”
“ওম্মা গো, মচকালি কী করে? নিশ্চয়ই ইস্কুলে দুষ্টু ছেলেগুলোর সঙ্গে হুটোপাটি করতে গিয়েছিলি!”
রামলাল করুণ একটু হাসলেন। ঠাকুমার ভীমরতির কথা তাঁর অজানা নয়। তবে রামলালকে ইস্কুলের ছেলে মনে করাটা বড় বাড়াবাড়ি।
রামলাল বললেন, “তাই গো ঠাকুমা। এবার দাও তো তোমার সেই চুনা হলুদের পট্টি বেঁধে।”
হরমোহিনীর নিজের হাতের চুন-হলুদের গরম পট্টি বহুঁকাল ধরে এই বাড়ির ছেলেপুলেদের ব্যথা-বেদনার পরম ওষুধ। হরমোহিনী তাড়াতাড়ি উঠে বললেন, “ওরে ও মোক্ষদা, যা তো মা, একটু চুন-হলুদ মিশিয়ে নিয়ে আয়, আংরায় গরম করে লাগিয়ে দিই।”
মোক্ষদা গজগজ করতে লাগল, “ডান হাঁটু বাঁ হাঁটুর জ্ঞান নেই, ছেলে বুড়োর জ্ঞান নেই, উনি আবার আমাকে হাঁটু চেনাতে লেগেছিলেন!”
এই কথাতে হরমোহিনী ফের জো পেয়ে নাতিকে সাক্ষী মেনে বললেন, “বল তো ভাই, এটা আমার কোন্ হাঁটু, ডান না বাঁ?”
রামলাল মাথাটাথা চুলকে বললেন, “ঠাকুমা, এ তো তোমার বাঁ হাঁটু বলেই সন্দেহ হচ্ছে।”
‘তবেই বল ভাই, মোক্ষদা হারামজাদি কিছুতেই মানছে না যে, এটা আমার বাঁ হাঁটু। তখন থেকে বলেই যাচ্ছে, আমি নাকি আমার হাঁটু চিনি না! কলিকাল কি আর সাধে বলে রে ভাই, হাঁটুর বয়সী মেয়ে সে এল আমাকে হাঁটু চেনাতে!”
মোক্ষদা ফোঁস করে উঠে বলল, “দুনিয়াসুদু লোক জানে যে, ওটা তোমার বাঁ হাঁটু। শুধু তুমিই জানতে না। তখন থেকে বলে যাচ্ছ যে, ওটা তোমার ডান হাঁটু।”
হরমোহিনী কপালে হাত দিয়ে বললেন, “কোথায় যাব মা, আবাগির বেটি বলে কী? কখন তোকে বললাম রে যে, এটা আমার ডান হাঁটু?”
আবার একটা ঝগড়া পাকিয়ে উঠছিল। রামলাল বিপদ দেখে তাড়াতাড়ি ঠাকুমার পাশে বসে পড়ে বললেন, “আমার যে খিদে পেয়েছে গো ঠাকুমা, কিছু খেতেটেতে দেবে নাকি?”
খাওয়ার কথায় হরমোহিনীকে যত বশ করা যায়, তত আর কিছুতে নয়। তিনি মনে করেন, ছেলেপুলেরা যত খাবে তত তাদের বুদ্ধি খুলবে, তত উন্নতি হবে।”
“খাবি ভাই?” বলে একগাল হাসলেন হরমোহিনী। তারপর উঠে জালের আলমারি খুলে একটি সর বের করে তাতে মিছরির গুঁড়ো ছড়িয়ে দিলেন।
“খা দেখি বসে বসে। সবটা খা।”
রামলালের খিদে নেই। তবু খেতে লাগলেন। সেই দৃশ্য দেখে ফোকলা মুখে খুব আহ্লাদের হাসি হাসতে লাগলেন হরমোহিনী।
ঠিক এই সময়ে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে নন্দবাবু ঘরে ঢুকলেন।
হরমোহিনী তাঁকে দেখে অবাক হয়ে বললেন, “নন্দ না কি রে?”
“হ্যাঁ ঠাকুমা।”
“তা তুই কোত্থেকে এলি ভাই? সবাই যে বলে তুই সাধু হয়ে হিমালয়ে চলে গেছিস!”
“এখনও যাইনি ঠাকুমা।”
“তা হলে তোর দেখা পাই না কেন? তুইও কি পা মচকেছিস? কে তোকে ল্যাং মারল?”
৩. ভুতোর মাথায় যখন পরি ভর করে
সবাই জানে, ভুতোর মাথায় যখন পরি ভর করে তখন একটা কিছু হবেই।
ভূতো এ-বাড়ির ছেলে নয়। এমনকী আত্মীয় পর্যন্ত নয়। তবু ভুতো এ বাড়ির একজন হয়ে গেছে। আগে তাকে দিয়ে বাড়িতে চাকর বাকরের কাজ করানো হত। তারপর তার খোলতাই মাথা আর নানা বাহাদুরি দেখে তাকে ইস্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। বাড়ির ছেলেদের সঙ্গে সেও পড়ে। বলতে গেলে সে-ই হল সদার পোড়ো।
তবে মুশকিল হল মাঝে-মাঝে তার মাথায় পরি ভর করে। কিন্তু পরি ভর করাটা কী?
তা ভুতো জানে না। তবে ভুতোর ভাষায়, সেই যে-বার দেশে খুব আকাল হল, তখন আমার বাবা একদিন আমাকে কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। সংসারে শুধু আমি আর বাবা-ই তো ছিলাম। মা কোকালে মরে গিয়েছে। তা বাবার কাঁধে করে যাচ্ছি তো যাচ্ছিই। চারদিকে পোড়া মাঠ, ঘাস নেই, পাতা নেই, গাঁ-গঞ্জ সব খরায় জ্বলে পুড়ে খাক। নদী, নালা, পুকুর, কুয়ো, টিপকল সব শুকনো। তেষ্টায় বাপ-ব্যাটার গলা কাঠ। তা সন্ধেবেলা আমরা একটা ভুতুড়ে বাড়িতে পৌঁছে গেলুম। বাবা বলল, “ওখানেই বাপ-ব্যাটায় রাত কাটাব।” বাবা গামছা পেতে আমাকে শুইয়ে দিয়ে বলল, “তুই একটু জিরো, আমি চিড়ে-মুড়ি কিছু একটু জোগাড় করে আনছি।” তা বাবা গেল, আর আমিও শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ধকল তো বড় কম যায়নি। তারপর হল কি, হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। দেখি কি, কোথায় সেই ভাঙা পুরনো বাড়ি, আর কোথায় বা বাবা। আমি দেখলুম, দিব্যি একটা ঘরের মধ্যে নরম বিছানায় আমি শুয়ে আছি। চারদিকে সব আমার বয়সী ছেলেমেয়ে। তবে সকলের পিঠেই একজোড়া করে ফিনফিনে পাখনা লাগানো। তারা বেশ উড়ছে, হাঁটছে, বসছে। কী সুন্দর সব চেহারা। আমি চোখ মেলতেই সবাই এসে আমাকে ঘিরে দাঁড়াল। আমি তো ভয় পেয়ে কেঁদে কেটে একশা। তারা আমার চোখের জল মুছিয়ে দিল, অনেক খাবার দিল, শরবত দিল, খেলনা দিল। আমি যতবার বাবার কাছে যাওয়ার বায়না করি ততবারই তারা কেবল মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে, আর তাদের মুখগুলো ভারি করুণ হয়ে যায়। তারা তাড়াতাড়ি আমাকে আরও খেলনা দিল, মজার মজার সব গল্প বলল, গান গাইল, নাচল। আমি বাবার দুঃখ ভুলেই গেলুম। তাদের ভারি সুন্দর বাগান ছিল। সেখানে বারোমাস রামধনু ফুটে থাকে আকাশে। সেখানে কখনও অন্ধকার হয় না। কারও কখনও অসুখ করে না, কেউ কখনও মরে না। সে ভারি মজার জায়গা।