রামলালের ঠাকুমা, অর্থাৎ ভুবন রায়ের মা হরমোহিনী দেবীর বয়স একশো এক বছর। তাঁর হাঁকেডাকে সবাই অস্থির। ডাকসাইটে ভুবন রায় এই দুনিয়ায় একমাত্র মাকেই ডরান। হরমোহিনীর বকাবকির চোটে এ-বাড়িতে ঝি-চাকর থাকতে চায় না, কাকপক্ষী আসতে চায় না, এমনকী কুকুর-বিড়াল অবধি এ বাড়িকে এড়িয়ে চলে। শুধু বুড়ি দাসী মোক্ষদাই হরমোহিনীকে ভয় খায় না। আর তার সঙ্গেই রোজ সন্ধেবেলা হরমোহিনীর তুলকালাম ঝগড়া হয়। আজও হচ্ছিল।
হরমোহিনীর পায়ে বাতের ব্যথা। তাতে গরম রসুনতেল মালিশ করতে বসেছে মোক্ষদা। কিছুক্ষণ মালিশ চলার পর হরমোহিনী হঠাৎ বললেন, “হ্যাঁ রে মোক্ষদা, ব্যথা আমার বাঁ হাঁটুতে, আর তুই কোন্ আক্কেলে আমার ডান হাঁটুতে মালিশ করতে লেগেছিস?”
মোক্ষদা সপাটে বলল, “হাঁটু তো তুমিই এগিয়ে দিল বাপু। আমি কি হাঁটু বেছে নিয়েছি? আমি তেমন বাপের মেয়ে নই যে, পরের হাঁটু নিয়ে বাছাবাছি করব। আর এও বলি বাপু, এটা তোমার বাঁ হাঁটুই।”
হরমোহিনী উঁচুতে গলা তুলে বললেন, “বড় মুখ বেড়েছে তোর মোক্ষা, এটা যদি আমার বাঁ হাঁটুই হবে তা হলে ব্যথাটা আমার ডান হাঁটুতে হচ্ছে কী করে?”
তা তোমার যদি ব্যাথা নিত্যি নিত্যি হাঁটু বদল করে তা হলে আমার আর কী করার আছে? তোমার খিটখিটে স্বভাব, কেবল ঝগড়া করবে বলে গলা চুলকোয়। নইলে ঠিকই বুঝতে পারতে যে, ব্যথা তোমার বাঁ হাটুতেই।”
“ওলো ভালমানুষের বেটি লো, আমাকে উনি হাঁটু চেনাতে এলেন। পাঁচ কুড়ি এক বয়সে কত হাঁটু দেখেছি তা জানিস? হাঁটুর তুই কী জানিস লা? আমার হাঁটু, আমার ব্যথা, আর উনি এলেন আমাকে হাঁটু চেনাতে!”
“তা বেশ বাপু, ঘাট মানছি। স্বীকার করছি হাঁটুও তোমার, ব্যথাও তোমার। কিন্তু কোন্ আকেলে তুমি তোমার বাঁ হাটুকে ডান হাঁটু বলে চালানোর চেষ্টা করছ বলো তো! তুমি যে দেখছি দিনকে রাত করতে পারো।”
“কখন আবার বাঁ হাঁটুকে ডান হাঁটু বললুম বল তো! ওম্মা, কী মিথ্যেবাদী রে! আমি তোকে বলিনি, ব্যথা আমার বাঁ হাঁটুতে। আর তুই মালিশ করছিস ডান হাঁটুতে?”
“বলেছ। আমিও কানে কালা নই যে শুনিনি। তুমি হাঁটুটা লেপের তলা থেকে ঠেলে বের করে দিলে, আমিও মালিশ করতে লাগলুম। এটা তোমার বাঁ হাঁটু ডান, তা নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথাটা শুনি! তোমার হাঁটু তুমি বুঝবে, আমার মালিশ করার কাজ মালিশ করে যাব।”
“তাই যদি হবে তা হলে বড় গলা করে আমাকে আমার হাঁটু চেনাচ্ছিস কেন?”
“নিজের হাঁটু যদি নিজেই না চেনো তা হলে লোকে আর কী করবে? তাও বলি বাপু, ভীমরতি ধরেছে সে কথা স্বীকার করলেই তো ল্যাটা চুকে যায়।”
“ভীমরতি আমাকে ধরবে কেন র্যা, ভীমরতি ধরেছে তোকে। নইলে কি আর ডান হাঁটুতে মালিশ করিস? আজ বেশ বুঝতে পারছি, কেন রসুন তেল নিত্যি মালিশ করেও আমার বাঁ হাঁটুর ব্যথাটা কমছে না। কী বুদ্ধিই না তোকে ভগবান দিয়েছেন! রোজ সন্ধেবেলা আমি একটু ঝিমোই, আর তুই মুখপুড়ি, এসে বাঁ হাঁটুর বদলে চুপিচুপি আমার ডান হাঁটুতে মালিশ করে যাস!”
“ভীমরতি নয় গো, তোমার মাথায় জিন-পরি কিছু ভর করেছে। তখন থেকে বলছি, এ-তোমার ডান হাঁটু নয়, এটা বাঁ হাঁটুহ, তাও কেন যে টিকির-টিকির করে যাচ্ছ?”
“ওরে আবাগির বেটি, এটা বাঁ হলে, আমার অন্য হাঁটুটা তা হলে কী? সেটাও কি বাঁ হাঁটু? তুই কি তা হলে বলতে চাস, বিধাতা আমাকে দু-দুটো হাঁটু দিলেন। আর দুটোই বাঁ হাঁটু? আর তাই যদি হবে তা হলে এতকাল আমি সেটা জানতে পারতুম না? তুই আমাকে বুঝিয়ে বল দেখি, এটা বাঁ হলে আমার অন্য হাঁটুটা কী হয়?”
“এ তো কানা মানুষও জানে গো, একটা বাঁ হলে অন্যটা ডান হবেই। কিন্তু তোমার মতো মানুষকে ভগবান যদি দুটো বাঁ হাঁটুহ দিয়ে থাকেন তাহলে আশ্চর্যের কিছু নেই। তোমার সবই তো অশৈলী কাণ্ড।”
“কী এমন তোকে বললুম বল তো মোক্ষদা যে, আমার হাঁটু নিয়ে খুঁড়ছিস! তখন থেকে পইপই করে বোঝাচ্ছি, ওরে মোক্ষদা, ভালোমানুষের মেয়ে, যদি এই হাঁটুটা আমার বাঁ হাঁটুই হবে তা হলে আমার অন্য হাঁটুটায় ব্যথা হচ্ছে কেন? তুই কি বলতে চাস ব্যথাটা আমার ডান হাঁটুতে? বাঁ হাঁটুতে নয়? এতকাল ধরে কি তবে আমি লোককে মিথ্যে করে বানিয়ে বলে আসছি যে, ব্যথাটা আমার বাঁ হাঁটুতে?”
“তাই তো বলছি গো, নিজের হাঁটু যে নিজে চেনে না তার কি মাথার ঠিক আছে। একশো বছর পার করলে বু এতদিনে ডান বাঁ চিনলে না, কেমন মানুষ তুমি বলে তো! পরের জিনিস তো আর নয়, একেবারে নিজের সহোদর দুটো হাঁটু। পাঁচটা-দশটাও নয়, মাত্র দু’খানা। একখানা ডান, একখানা বাঁ। তাও যদি চিনতে তোমার একশো বছরে না কুলোয়, তবে আর এ জন্মে তোমার হাঁটুজ্ঞান হবে না।”
“খুব যে গলা তুলে ঝগড়া করছিস, ডাক দেখি পাঁচজনকে। যা, গিয়ে মোড়ল মাতব্বর-মুরুব্বিদের ধরে নিয়ে আয়। সালিশ করুক। তারাই ঠিক করুক কোন্টা আমার বাঁ হাঁটু, আর কোন্টা ডান। তারপর তোমার মুখের মতো জবাব দেব। ভুবনটাকে ডাক তো, যা…”
‘আর সালিশ বসাতে হবে না। মোড়ল-মাতব্বরদের তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই, তাঁরা আসবেন তোমার হাঁটুর বিচার করতে! সালিশ বসলে লজ্জার আর বাকি থাকবে না কিছু। সারা শহরে টিটি পড়ে যাবে। সবাই বলে বেড়াবে, ভুবন রায়ের মা হরমোহিনী নিজের দু’খানা হাঁটু একশো বছরেও চিনে উঠতে পারেনি। ছিঃ ছিঃ।”