আবিষ্কারগুলো কেমন হল, তা ভুবন রায় একদিন রামলালের কাছে জানতে চাওয়ায় রামলাল বিজ্ঞানের এইসব নিষ্ফল আবিষ্কারের কিছু ঘটনার কথা মনের ভুলে বলে ফেলেছিলেন। ভুবন রায় ছেলের ওপর এমন খাপ্পা হয়ে গেলেন যে, রাত্রে সেদিন জলস্পর্শ করলেন না, এবং সারারাত ল্যাবরেটরিতে জেগে কালজয়ী কিছু একটা আবিষ্কার করার জন্য উঠেপড়ে লেগে রইলেন। তিন-চারদিন তাঁর নাওয়া-খাওয়ার হুঁশ রইল না।
তারপর একদিন একটা দূরবীনের মতো যন্ত্র নিয়ে বেরিয়ে এসে সগর্বে সবাইকে বললেন, “ইউরেকা! ভুত দেখার যন্ত্র আবিষ্কার করেছি।”
শুনে সবাই আঁতকে উঠল।
কিন্তু সমস্যা হল, যন্ত্রটা চোখে দিয়ে ভুবন রায় নানা আকৃতির অজস্র ভূত দেখতে পান বটে, এবং তার ধারাবিবরণীও দিতে থাকেন, “ওই যে একটা শুটকো ভুত পান্তা ভাত খাচ্ছে… ওই যে একটা পেত্নি আকাশে চুল ছড়িয়ে দাঁত বের করে হাসছে… ওই তো শিবচন্দ্র কামারের ভূত হরিহর পালের ভূতকে ধরে ঠ্যাঙাচ্ছে…” ইত্যাদি, কিন্তু সেই যন্ত্র দিয়ে আর কেউ অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না। কিন্তু সে কথা ভুবন রায়কে বলে, এমন সাহস কার?
রামলালকেও স্বীকার করতে হল যে, যন্ত্রটা দিয়ে আবছা আবছা ভৌতিক কিছু দেখা যায় বটে।
ভুবন রায় চটে উঠে বললেন, “আবছা-আবছা মানে, স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। ভাল করে দ্যাখো।”
রামলাল আমতা-আমতা করে বললেন, “আজ্ঞে স্পষ্টই।”
“কী দেখছ বলো।”
অগত্যা রামলাল বানিয়ে বলতে লাগলেন, “আজ্ঞে একটা রোগা আর একটা মোটা ভুত কুস্তি করছে… আর একটা পেত্নি ডালের বড়ি দিচ্ছে…”
“তবে?” বলে খুব হাসলেন ভুবন রায়। তারপর ছেলেকে বললেন, “কিন্তু তুমি কী করছ? এখনও তো একটাও কিছু আবিষ্কার করতে পারলে না।”
“আজ্ঞে না।”
“সাত দিন সময় দিলাম। কিছু একটা করে দেখাও। দীর্ঘদিন মাস্টারি করে মাথার বারোটা বাজিয়েছে। মাথাটা এবার খাটাও।”
“যে আজ্ঞে।”
সুতরাং রামলালকে কাজে লাগতে হল। কী করবেন, তা তিনি ভেবেই পাচ্ছিলেন না।
একদিন তিনি বসে বসে ভুবন রায়ের আবিষ্কৃত জিনিসগুলি নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন। হঠাৎ তাঁর মনে হল, ল্যাবরেটরির মধ্যে একটা যেন কিছু ঘটছে।
.
ল্যাবরেটরিতে কী ঘটেছে তা রামলাল বুঝতে পারলেন না বটে, কিন্তু তাঁর মনে হল, বিশাল গোয়াল ঘরটার কোনও একটা প্রান্তে কেউ একজন নড়াচাড়া করছে।
রামলাল খুবই ভিতু মানুষ। তিনি সভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কে ওখানে?”
কেউ থাকার কথাও নয়। ল্যাবরেটরির একটামাত্র দরজা। রামলাল ঢুকেছেন এবং নিজের হাতে ছিটকিনি বন্ধ করেছেন। সুতরাং কে হতে পারে?
রামলালের প্রশ্নের জবাব অবশ্য কেউ দিল না। কিন্তু রামলাল সুস্পষ্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলার শব্দ পেলেন। তারপর শুনলেন, ক্যাবিনেট খুলে কে যেন একটা টেস্টটিউব বের করল। তারপর একটা টিউবের মধ্যে একটা তরল জিনিস পড়ার শব্দ হল।
রামলাল শিউরে উঠলেন। তারপরই তারস্বরে “রাম… রাম… রাম… বাবা রেমা রে ….”, বলে চেঁচাতে চেঁচাতে দড়াম করে এসে দরজায় ধাক্কা খেলেন। ছিটকিনিটা কোনওরকমে খুলে এক লাফে উঠোনে পড়ে দৌড়তে গিয়ে আছাড় খেলেন। গোড়ালি মচকে গেল। তা সত্ত্বেও উঠে ল্যাংচাতে-ল্যাংচাতে ছুটতে লাগলেন। মুখে “বাঁচাও… বাঁচাও…” চিৎকার।
কিন্তু মুশকিল হল, ল্যাবরেটরিটা বাড়ির পিছন দিকে এবং অনেকটা দূরে। এদিকটায় অনেকটা ফাঁকা জমি, বাগান। কেউ তাঁর চেঁচানি শুনতে পেল না। বকুলগাছের তলায় রামলাল আবার বড় ঘাসে পা আটকে পড়ে গেলেন এবং সেখান থেকে সভয়ে ল্যাবরেটরির দিকে একবার চেয়ে দেখতে গিয়ে তিনি একেবারে হাঁ।
প্রকাণ্ড দরজাটা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল, ল্যাবরেটরির মধ্যে কে যেন দিব্যি আলোগুলো নিভিয়ে দিয়েছে। অন্ধকারে একটা বুনসেন বানারের আগুন দেখতে পেলেন রামলাল।
এরপর মচকানো পা নিয়েই যে দৌড়টা দিলেন রামলাল, তেমন দৌড় বোধহয় কার্ল লিউসও ওলিম্পিকের একশো মিটারে দৌড়তে পারেনি।
ভুবন রায় ক্রু কুঁচকে রামলালের দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর হঠাৎ বললেন, “দৌড়ে এলে মনে হচ্ছে! বাঃ, খুব ভাল। এতদিনে যে নিজের শরীরের দিকে নজর দিয়েছ, এতে আমি খুব খুশি। তবে এখন রাত ন’টা বাজে। এ সময়টায় দৌড়নোই ভাল।”
রামলাল হ্যাঁ-হ্যাঁ করে ফাঁফাচ্ছিলেন যে, কথার জবাব দেওয়ার মতো অবস্থা ছিল না!
ভুবন রায় তাকে উদ্দেশ করে বললেন “সকালে উঠে দৌড়নোই ভাল। মাইলটাক দৌড়লেই দেখবে তোমার মতো নীরেট মাথাও কেমন চনমন করে উঠছে।”
হ্যাঁ-ত্যা করতে করতেই রামলাল মাথা নেড়ে জানালেন যে, যথা আজ্ঞে।
ভুবন রায় ছেলের দিকে চেয়ে হঠাৎ কিছু মনে পড়ায় বললেন, “ওঃ হো, তোমাকে বলতে ভুলে গেছি। আমি একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট পেয়েছি। বুড়ো মানুষ। তুমিও তাঁকে চিনবে। হাইস্কুলের সায়েন্সের টিচার ছিলেন। নাম দুলাল সেন। তিন কুলে কেউ নেই, অভাবেও পড়েছিলেন খুব। তার ওপর আবার কানে একদম শুনতে পান না। আজ থেকে তিনি আমাদের ল্যাবরেটরিতেই রয়েছেন। একেবারে কোণের দিকে একটা চৌকি পেতে দিয়েছি, সেখানেই থাকছেন আর একটু-আধটু কাজকর্মও করছেন। ল্যাবরেটরিতে গেলেই তাঁকে দেখতে পাবে।”
এ কথায় রামলাল ভীষণ ক্ষুব্ধ হলেন বটে, কিন্তু কিছু বলার জো নেই। হাঁফাতে-হাঁফাতে করুণ নয়নে চেয়ে রইলেন বাবার দিকে। তারপর ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে বেরিয়ে ঠাকুমার কাছে গিয়ে বসলেন।