কিন্তু ধাক্কা আর দিতে হল না। হঠাৎ ভিতর থেকে একটা আলোর ঝলকানি আর সেইসঙ্গে বিস্ফোরণের শব্দ এল। ঘরের ভিতরটা নীলবর্ণ ধোঁয়ায় ভর্তি হয়ে গেল। একটা কটু গন্ধ বেরোতে লাগল ঘর থেকে।
ভুবনবাবু বির্বণ মুখে বললেন, “এ কী?”
রামলাল চিন্তিতভাবে বললেন, “একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে।“
নন্দলাল দশ হাত পিছিয়ে গিয়েছিলেন। একটু কম্পিত গলায় বললেন, “আমি আগেই বলেছিলুম কিনা যে, বিজ্ঞান খুব খারাপ জিনিস!”
তিনজন খানিকক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রসলেন। ধীরে ধীরে ভিতরকার ধোঁয়াটে ভাবটা কেটে ঘরটা আবার পরিষ্কার হয়ে এল।
দরজা খুলে হেলমেট পরা ভুতো বেরিয়ে এসে উত্তেজিত গলায় বলল, “দুলালবাবু অজ্ঞান হয়ে গেছেন। তবে ভয় নেই।”
বনবাবু ভারি রেগে গিয়ে বললেন, “ভয় নেই মানে? বিজ্ঞান কি ছেলেখেলা নাকি? এ খুব বিপজ্জনক জিনিস। কী থেকে কী হয় তা আমার মতো পাকা সায়েন্টিস্টও সবসময় ঠাহর পাই না। চলো তো দেখি লোকটার কী হল।”
দুলালবাবু মেঝের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে রয়েছেন। জ্ঞান নেই, তবে নাড়ি চলছে। শ্বাসও বইছে। মুছে চোখে বেশ কিছুক্ষণ জলের ঝাঁপটা দেওয়া হল। পুরনো জুতো এনে শোঁকানো হল। চিমটি কাটা হল। কাতুকুতু এবং সুড়সুড়িও দেওয়া হল।
প্রায় ঘণ্টাখানেক চেষ্টার পর দুলালবাবু মিটমিট করে চাইতে লাগলেন।
ভুবনবাবু একটু ভয়ের গলায় বললেন, “ইয়ে রামলাল, দড়িটড়ি যা পাও নিয়ে এসো। লোকটা যদিও আমাদের সেই দুলালবাবু বলেই মনে হচ্ছে, তবু সাবধানের মার নেই। ভাল করে জ্ঞান ফেরার আগেই হাত-পা বেঁধে ফেলল। নইলে আবার হয়তো বিপদ ঘটাবেন।”
ভুতো মাথা নেড়ে বলল, “আমার তা মনে হয় না। দুলাল-সারের যে অসুখ হয়েছিল তা বোধ হয় সেরে গেছে।”
দুলালবাবু ভুবনবাবুকে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে বসলেন, তারপর হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে ভারী নিরীহ মুখে নরম গলায় বললেন, “ভালো আছেন তো?”
ভুবনবাবু একটু ভড়কে গিয়ে বললেন, “তা ভালই বলা যায়। কিন্তু আপনি কেমন আছেন?”
দুলালবাবু চারদিকে চেয়ে বললেন, “আমি বোধ হয় অসময়ে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। মাফ করবেন।”
সবাই বুঝতে পারছিল, সেই আগের দুলালবাবুই আবার ফিরে এসেছেন।
ভুবনবাবু একটু অভিমানের গলায় বললেন, “ইয়ে, আপনি কিন্তু আমাকে বিশেষ রকমের অপমান করেছেন।”
“অপমান!” বলে দুলালবাবু ভারি ভিতু চোখে চেয়ে রইলেন। ভুবনবাবু বললেন, “আপনি বলেছেন যে, আমি এই শহরের সবচেয়ে বোকা আর আহম্মক লোক।”
দুলালবাবু তাড়াতাড়ি নিজের কান দু হাতে চাপা দিয়ে আর্তনাদ করে উঠলেন, “ছিঃ ছিঃ ওরকম কথা কানে শোনাও যে পাপ।”
“আমি তা হলে আহাম্মক নই?”
দুলালবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “সে কথাও আমি বলতে পারব না। আমি সামান্য মানুষ, বড় বড় মানুষেরা কে কেমন তার কী জানি?”
“আপনি কবিতা কেনার নাম করে আমাকে ঠকিয়েছেন। ঠিক কিনা? অনেক চুরি, মিথ্যে কথা আর ডাকাতিরও অভিযোগ আপনার বিরুদ্ধে আছে।”
দুলালবাবু আকাশ থেকে পড়লেন। মুখে বাক্য সরল না।
৯. দিন-দুই বাদে এক সকালে
দিন-দুই বাদে এক সকালে দুলালবাবু ল্যাবরেটরির এক কোণে ছোট একটা স্টোভে সেদ্ধভাত রান্না করছিলেন, এমন সময় জানলার বাইরে একটা লোক এসে দাঁড়াল। মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি, ন্যাড়া মাথায় সদ্য-গজানো খোঁচা-খোঁচা কাঁচাপাকা চুল, দু’খানা চোখ জ্বলজ্বল করছে।
লোকটা চাপা গলায় ডাকল, “দুলালবাবু!”
দুলালবাবু চমকে উঠে বললেন, “আজ্ঞে।”
লোকটা মাথা চুলকে বলল, “এসব কী হচ্ছে দুলালবাবু?”
“দুলালবাবু ভারি ভয় খেয়ে বললেন, “আজ্ঞে, সেদ্ধভাত রান্না করছি, কোনও অন্যায় করিনি তো!”
“আপনার মতো ওস্তাদ লোক সেদ্ধভাত রান্না করে শক্তির অপচয় করলে অন্যায় নয়?”
দুলালবাবু আরও ভয় খেয়ে বললেন, “আজ্ঞে, আপনাকে তো ঠিক চিনে উঠতে পারছি না।”
“চিনতে পারছেন না! বলেন কী দুলালবাবু? আমি যে আপনার শাগরেদ পাঁচু মোদক। দুজনে মিলে কত কী করলুম, সব ভুলে মেরে দিয়েছেন নাকি?”
দুলালবাবু ভারি অবাক হয়ে বললেন, “আমি কি কিছু করেছি পাঁচুবাবু?”
পাঁচু খুব খকখক করে হেসে বলে, “কত কী করলুম, আর আপনার মনে পড়ছে না? ভূত ধরা, সোনার দোকানে ডাকাতি করা, ভুবনবাবুর বাড়িতে চুরি, ক্রিকেট খেলা কত কী!”
দুলালবাবু কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন, “চুরি! ডাকাতি! ক্রিকেট! ও বাবা, আমি যে জন্মেও ওসব কখনও করিনি, আপনি আর আমাকে ভয় দেখাবেন না আমি ভারি ভিতু লোক।”
পাঁচু হাঁ করে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, “আপনি ভিতু লোক! হাসালেন মশাই। আপনি না ভূত ধরার ব্যবসা করতে চেয়েছিলেন! আপনি দারোগাবাবুর কম হেনস্থা করে ছেড়েছেন? ভুবনবাবুর মতো ডাকসাইটে লোককে নাকের জলে চোখের জলে করে ছাড়েননি আপনি?”
দুলালবাবু অত্যন্ত আতঙ্কের চোখে পাঁচুর দিকে চেয়ে ছিলেন। হঠাৎ দু’হাতে কান ঢেকে বললেন, “ওসব কথা কানে শোনাও যে পাপ পাঁচুবাবু! শুনেই যে আমার ভয় করছে।”
পাঁচু হাঃ হাঃ করে হেসে বলল, “সাধু সেজে লাভ নেই দুলালবাবু। আমি আপনাকে ভালই চিনেছি। তা সাধু সেজে কি নতুন কোনও প্যাঁচ কষছেন নাকি? আপনার মাথায় যা বুদ্ধি, হয়তো মিনমিনে সেজেই ঝপ করে একটা দাঁও মেরে ফেললেন। তা বলে পাঁচু মোদককে ভুলবেন না যেন!”