দুলালবাবুকে বেরোতে দেখেই পাঁচু টপ করে উঠে পড়ল। কাণ্ডখানা সেও আড়াল থেকে দেখেছে। এ বাড়িতে তাদের আর জারিজুরি খাটবে না। তারা ধরা পড়ে গেছে। তবে দুলালবাবুর যা এলেম দেখছে পাঁচু, এ-বাড়ি হাতছাড়া হলেও ক্ষতি নেই। কত বাড়ি শহরে, আছে আরও কত আহাম্মক।
পথে এসে সে দুলালবাবুর সঙ্গ ধরে ফেলে একগাল হেসে বলল, “আগেই বলেছি কিনা আপনাকে কোনও ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করতে নেই। কবিতা নিয়ে আপনি কী কাণ্ডই না করলেন। গেল দাঁওটা ফসকে।”
দুলালবাবু মাথাটা একটু চুলকে নিয়ে বললেন, “একেবারে যে বুঝি না তা নয় হে, তবে কিনা আমি এলাইনে নতুন তো, সবে দাঁত উঠেছে, এখন যা দেখি তাই কামড়াতে ইচ্ছে যায়। তবে ভুবনবাবু লোকটা একেবারেই আহাম্মক। অথচ এ-লোকটাকে সবাই ভারি খাতির করে, ভয়ও খায়। কেন বলো তো!
“তা জানি না। আমি আবার সবাইকেই ভয় খাই কিনা, আলাদা করে কারও কথা বলতে পারব না।”
“তা এখন কী করা যায় বলো তো পাঁচু। বসে বসে সময় কাটানো তো আমার ধাত নয়। আমার কাজ চাই, যে কাজে বিপদ আছে, অ্যাডভেঞ্চার আছে, নতুনত্ব আছে।”
পাঁচু দুলালবাবুর কাঁধে হাত রেখে বলল, “সে কথাই তো ভাবছি, চলুন ডেরায় ফিরে দুজনে মিলে একটু ভেবেচিন্তে শলাপরামর্শ করে ঠিক করি। হুটহাট নানা কাণ্ড বাধিয়ে কাজ পণ্ড হচ্ছে।”
দুলালবাবু একটু গুম মেরে গেলেন। দু’জনে বাকি পথটা আর বিশেষ কথাবার্তা হল না। ভৌত ক্লাবের পাশ কাটিয়ে তারা যখন পোড়াবাড়িটার ভিতরে ঢুকলেন, তখন সন্ধে হয়ে আসছে। চারদিকে কুয়াশায় মাখা ভুতুড়ে একটা আলো। যে-কোনও মানুষের গা ছমছম করবে। তবে দুলালবাবু বা পাঁচুর সেবালাই নেই।
ঘরে ঢুকে পাঁচু তার লণ্ঠন জ্বালল। বলল, “সন্ধেবেলাটা কাজ কারবারে পক্ষে বেজায় খারাপ। এই সময়টায় একটু জিরিয়ে নিন। রাত নিশুত হলে বেরনো যাবে।”
এই বলে পাঁচু তার বিছানায় শুয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
দুলালবাবুর অবশ্য ঘুম এল না। তিনি সহজে ক্লান্ত হন না। তার ওপর শরীরটা যেন কিছু করার জন্য সর্বদাই টগবগ করছে।
দরজায় কাঁচ করে একটা শব্দ হল। তা ওরকম হয়। দরজা বলতে একটা মাত্র পাল্লা, তাও একটা কবজা ভাঙা বলে কাত হয়ে ঝুলে থাকে। সারাদিনই বাতাসে নড়ে আর কাঁচকোচ শব্দ করে।
দুলালবাবু পাঁচুর দেখাদেখি জিরনোর চেষ্টা করতে গিয়ে দেখলেন, শরীরটা যেন জিরোতে চাইছে না। কাজ করতে চাইছে। পাঁচুর বয়স হয়েছে, তাকে সব সময়ে সঙ্গে টানাটা ঠিক নয়। বেচারার ভারি কষ্ট হয় বোধ হয়। দুলালবাবু ঠিক করলেন, আজ একাই বেরিয়ে পড়বেন। আর এক্ষুনিই।
ভেবেই তড়াক করে উঠে বসলেন তিনি। তারপরই ভারি অবাক হয়ে চেয়ে দেখলেন, তাঁর সামনেই একটা ছেলে দাঁড়িয়ে। ছেলেটার মাথায় একটা সাদা হেলমেট।
দুলালবাবু হাতে হাত ঘষে ভারি আমুদে গলায় বললেন, “কাজ শিখতে চাও? তা শেখাব। চুরি-জোচ্চুরি ডাকাতি যা চাও সব শেখাতে পারি।”
ছেলেটা দু’পা কাছে এগিয়ে এসে বলল, “আমি একটা ফর্মুলার অর্থ করতে পারছি না। করে দেবেন?”
দুলালবাবু হাঁ করে চেয়ে থেকে বললেন, “ফর্মুলা? সে আবার কী জিনিস?”
“আপনি একসময়ে ফর্মুলায় পণ্ডিত ছিলেন।”
দুলালবাবু ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “ছিলুম নাকি? তা হবে। ওসব আমি এখন ভুলে মেরে দিয়েছি। এখন চুরি-ডাকাতি করে বেড়াই আর তাতে ভারি আনন্দ। লোকগুলোও ভীষণ বোকা।”
‘আপনি একটু চেষ্টা করলে ফর্মুলাটার মানে কিন্তু বলতেপারবেন। দেখুন একটা চেষ্টা করে।” দুলালবাবু ঘন-ঘন মাথা নেড়ে বললেন, “না, না। ওসব আমি জানি না।”
ছেলেটা করুণ মুখ করে বলল, “কিন্তু সবাই যে বলে এ-ফর্মুলার অর্থ একমাত্র দুলাল-সার ছাড়া কেউ করতে পারবে না।”
“বলে নাকি? ভারি মজার ব্যাপার তো!”
“আপনার মনে নেই সার, সেই যে ইস্কুলে পড়ানোর সময়…”
‘ইস্কুল! ও বাবা! ওসব কথা উচ্চারণও কোরো না। ইস্কুল খুব খারাপ জিনিস।”
“খারাপ কেন সার?”
“ইস্কুলে সব ভাল-ভাল কথা শেখায়। সেগুলো আসলে খুব বাজে জিনিস, তাতে কোনও মজা নেই। আসল মজা হল চুরি করা, বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে কথা বলে মানুষকে বোকা বানানো, মারপিট করা। বুঝলে? ইস্কুল-টিস্কুলে কক্ষনো যাবে না।”
ছেলেটা ভারি উৎসাহ পেল যেন। একগাল হেসে বলল, “আর মাস্টারমশাইরা খুব মারেও সার। গাঁট্টা খাওয়ার ভয়ে এই দেখুন না আমি মাথায় শক্ত টুপি পরে আছি।”
“খুব বুদ্ধির কাজ করছে।” তা হবে নাকি আমার শাগরেদ? দু-চার দিনেই সব শিখিয়ে দেব। ওই পাঁচু মোদকটাকে নিয়ে কাজ হচ্ছে না। বড় কুঁড়ে, আর একটু পরিশ্রমেই ভারি হেদিয়ে পড়ে।
ছেলেটা মাথা নেড়ে বলল, “আপনার শাগরেদ হওয়া তো ভাগ্যের কথা সার।”
“তা হলে চলো, বেরিয়ে পড়া যাক।”
ছেলেটি ঘাড় নেড়ে সঙ্গে সঙ্গে বলল, “চলুন সার। যেতে-যেতে ফর্মুলাটা কি একবার শুনে নেবেন?”
“ফর্মুলা! হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি একটা ফর্মুলার কথা বলছিলে বটে। কিন্তু ওসব শক্ত আর গুরুগম্ভীর ব্যাপারে মাথা ঘামানোর দরকার কী আমাদের? চুরি-ডাকাতিতে ঢের মজা।”
“সে তো জানিই। কিন্তু ফর্মুলার ব্যাপারটা আমার মাথা থেকে কিছুতেই যাচ্ছে। না গেলে অন্য কাজে মন দেব কী করে?”
দুলালবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “তা অবশ্য ঠিক কথা। তা বলো শুনি।”