রামলাল মাথা চুলকোলেন। তারপর বললেন, “সব ব্যাপার এখনও ঠিকমতো ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু খুঁজলে ব্যাখ্যা পাওয়া যাবেই। তবে বাবার আবিষ্কারের কথা যা বলছিস, তা কিন্তু ঠিক নয়। বাবা এ-যাবৎ কিছুই আবিষ্কার করেননি। তবে তাঁর সঙ্গে তো তর্ক করা যায় না, আমি ভয়ে-ভয়ে সব মেনে নিয়েছি। সে যাকগে, এখন কী করা যায় সেটাও হল চিন্তার বিষয়।”
ভুতে তার হেলমেটটা টেবিলের তলা থেকে এনে বলল, “তোমাদের কিছুই করতে হবে না। দু’জনে যেমন বসে আছে, তেমনই চুপটি করে বসে থাকো। যা করার আমি করছি।”
রামলাল আর নন্দলাল সভয়ে চেয়ে দেখলেন, ভুতো হেলমেটটার মধ্যে কী একটু কারিকুরি করে সেটা মাথায় পরে নিল, ধীরে ধীরে ভুতোর মুখশ্রী পালটে যেতে লাগল। গম্ভীর মুখ, ধ্যানমগ্ন চোখ। ফিসফিস করে মাঝে-মাঝে অদ্ভুত সব ফরমুলা আউড়ে যাচ্ছে।
ভাগ্য ভাল যে, ভুবনবাবুর আদেশমতো ল্যাবরেটরির জিনিসপত্র এখনও সব সরিয়ে ফেলা হয়নি। দু-একদিনে তা সম্ভবও নয়।
ভুতো নানারকম কেমিক্যাল মেশাতে লাগল টেস্টটিউবে। তারপর বার্নার জ্বেলে তা গরম করতে লাগল। একটা কটু গন্ধ ছড়িয়ে পড়তে লাগল চারদিকে।
খানিকক্ষণ বাদে ভুতো নন্দলালের দিকে চেয়ে বলল, “দুলালবাবুকে একবার এই ঘরে আনতে হবে। এক্ষুনি। আর তোমরা ল্যাবরেটরির বাইরে থাকবে।“
নন্দলাল আর রামলাল দু’জনেই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে।
কিন্তু মুশকিল হল, দুলালবাবুর মতো ষণ্ডা-গুণ্ডা লোককে ইচ্ছের বিরুদ্ধে ধরে ল্যাবরেটরিতে আনা যায় কীভাবে? ভুবনবাবুও হয়তো ব্যাপারটা পছন্দ করবেন না।
দুই ভাই তাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন।
এদিকে দুলালবাবু খালি পেটে চা খাবেন না বলে কচুরি, আলুর দম এবং আনুষঙ্গিক বিশাল ভোজ নিয়ে বসে গেছেন। সামনে বিগলিত মুখে দাঁড়িয়ে আছেন ভুবনবাবু।
দুই ভাই কঁচুমাচু ঘরে ঢুকতেই ভুবনবাবু একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, “কী চাই?”
নন্দলাল মাথা চুলকে হঠাৎ বলে ফেললেন, “বাড়িতে পুলিশ এসেছে।”
“পুলিশ!”
“যে আজ্ঞে। তারা ওঁকে খুঁজছে।”
ভুবনবাবু যেমন হাঁ, দুলালবাবুও তেমনই হাঁ।
ভুবনবাবু বললেন, “ওঁকে খুঁজবে কেন? উনি কী করেছেন?”
নন্দবাবুর সঙ্গে এবার রামলালও যোগ দিয়ে বললেন, “ওদের মতলব বিশেষ ভাল ঠেকছে না। বলছে, সাপ্তাহিক নবযুগ থেকে যে-লোকটা কবিতা কিনতে এসেছে, সে একজন ক্রিমিনাল।”
ভুবনবাবু অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, “আর তোমরা সে কথা বিশ্বাস করলে?”
দু’ভাই একসঙ্গেই মাথা নাড়লেন। রামলাল বললেন, “আমরা পুলিশের কথায় মোটেই বিশ্বাস করিনি। বরং বলেছি, উনি এ বাড়িতে নেই। তবে আমাদের কথায় তারা কান দিচ্ছে না। বাড়িতে ঢুকে নিজেরা দেখতে চাইছে।”
“চলো, আমি গিয়েই দেখছি।” বলে ভুবনবাবু আস্তিন গোটাতে লাগলেন। তবে তার গায়ে ফুলহাতা জামা নেই, একটা ফতুয়া রয়েছে। তাই আস্তিন না পেয়ে তিনি কাল্পনিক আস্তিনই গোটালেন।
রামলাল আর নন্দলাল সমস্বরে বলে উঠলেন, “আমরা থাকতে আপনি কেন ব্যস্ত হচ্ছেন?”
“তোমরা কী করতে চাও?”
রামলাল সবিনয়ে বললেন, “উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। পুলিশ বাড়িটাই শুধু খুঁজবে। ল্যাবরেটরিটা একটু তফাতে, ওটাতে যাবে না। সুতরাং আধঘণ্টার মতো ল্যাবরেটরিতে গা-ঢাকা দিয়ে থাকলে কোনও চিন্তা নেই।”
“ল্যাবরেটরিতে যে যাবে না তা কী করে বুঝলে?”
রামলাল কাঁচুমাচু মুখে বললেন, “ওরা নিজের মুখেই বলল কিনা। শুধু ঘরগুলো দেখে যাবে। তাছাড়া ইদানীং ল্যাবেরেটরিতে নানা ভুতুড়ে কাণ্ড হওয়ায় ওটাকে সবাই ভয় খায়।”
দুলালবাবু নিবিষ্ট মনে খেতে-খেতে কথাগুলো শুনছিলেন। তত পাত্তা দিচ্ছিলেন। খাবার শেষ করে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বললেন, “অত ঘাবড়াচ্ছেন কেন ভুবনবাবু? পুলিশ-টুলিশ আমার কিছু করতে পারবে না। এই তো সেদিন বাজারে মধ্যে সোনার দোকান লুঠ করতে ঢুকেছিলুম। পাঁচুর আহাম্মকিতে কাজ প্রায় কেঁচে গিয়েছিল আর কি। তারপর দারোগা এসে হাজির। এমন প্যাঁচ কষলুম যে, দারোগাবাবাজি চিতপটাং! হেঃ হেঃ, ওসব আমার কাছে নস্যি।”
ভুবনবাবু চোখ গোল থেকে গোলতর হয়ে উঠছিল। নিজের কানকে যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। অস্ফুট গলায় বললেন, “বলেন কী!”
দুলালবাবু চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, “এ আর এমন কী আরও যেসব কাণ্ড করেছি তা শুনলে মূর্ছা যাবেন। তবে যা-ই বলুন, এস চুরি-জোচ্চুরির লাইনটা ভারি ইন্টারেস্টিং। আর লোকজনও ভারি বোকা।”
রামলাল আর নন্দলাল পরস্পরের দিকে চেয়ে নিলেন। তারপর রামলাল গলাখাঁকারি দিয়ে বললেন, “তা হলে যে একবার উঠতে হচ্ছে দুলালবাবু।”
দুলালবাবু চা শেষ করে উঠে বললেন, “ভুবনবাবু, আমি সারা শহর ঘুরে দেখলুম, আপনার মাথাতেই বুদ্ধিটা সবচেয়ে কম।”
“অ্যাঁ! বলেন কী?”
“আজ্ঞে, ঠিকই বলছি। আচ্ছা, গুডবাই। ভয় নেই। পুলিশ আমাকে ধরতে পারবে না।
এই বলে দুলালবাবু ঘর থেকে বেরোতে যেতেই নন্দলাল আর রামলাল দু’দিক থেকে তার দু’পায়ে ল্যাং মারলেন। ভুবনবাবু ঘরের কোণ থেকে তার লাঠিটা নিয়ে এসে দমাস করে এক ঘা কষিয়ে দিলেন দুলালবাবুর পিঠে।
দুলালবাবু যে তাতে বিশেষ কাহিল হয়েছেন তা মনে হল না। পড়ে গিয়ে এবং লাঠির ঘা খেয়েও টপ করে উঠে দাঁড়িয়ে তিন রদ্দায় তিনজনকে ছিটকে দিয়ে ঘরের বাইরে এসে পড়লেন। মুখে দিব্যি হাসি-হাসি ভাব।