“আজ্ঞে, আমার প্রায় চার বস্তা কবিতা পড়ে আছে। বাজারটা মন্দা ছিল বলে এতদিন ছাড়িনি। তা ভাল দর পেলে ভাবছি ছেড়ে দেব।”
ভুবনবাবু লোকটার কাঁধে হাত রেখে ভারি নরম গলায় বললেন, “আহা, কবিতা কেনার জন্য তো আমিই আছি। একটু সুবিধে করে যদি দাও তো ওই চার বস্তাই কিনে নেব’খন।”
লোকটা ভারি খুশি হয়ে বলল, “আজ্ঞে, আমারও খুচরো বিক্রি পোষাবে। চার বস্তা নিলে ওই পাইকারি দরেই পাবেন। কিছু আগাম পেলে একেবারে ঠেলাগাড়িতে চাপিয়ে এনে ফেলব।”
“হবে’খন। তোমাকে বাপু আর কবিতার দালাল খুঁজতে হবে না। কাল সকালের দিকে চলে এসো।”
“আজ্ঞে আগামটা?”
“এই পঞ্চাশটা টাকা রাখো। বাকিটা একেবারে নগদা-নগদি।”
“দরটা জানলেন না? গোনা বাছা না করলে পাঁচশো টাকা প্রতি বস্তা। আর যদি গোনা বাছা করেন তা হলে কিন্তু দর ছ’শো হয়ে যাবে।”
“ওরে বাবা, গোনা বাছার কথাই ওঠে না। তুমি কি আর আমাকে ঠকাবে?
আমি মানুষকে বিশ্বাস করতে ভালবাসি।”
লোকটা পায়ের ধুলো নিয়ে বিদেয় হল।
ভুবনবাবু হাসি-হাসি মুখে গিয়ে কবিতার পাইকারের ঘরে উঁকি দিলেন, “উঠেছেন নাকি আজ্ঞে?”
লোকটা একটা হাই তুলে পাশ ফিরে বলল, “উঠেছি। তবে যা খাইয়েছেন তাতে আরও ঘুমনো যেত।”
“এবার একটু যদি চা ইচ্ছে করেন।”
“চা! আমার আবার খালি পেটে চা চলে না।”
“খালি পেটে! বলেন কী? খালি পেটে চা খাওয়ানোও যে পাপ! এক্ষুনি ব্যবস্থা হচ্ছে। তা লুচি-টুচি চলবে তো! নাকি কড়াইশুটির কচুরি? সঙ্গে খানকয়েক চপ টপ যদি হয়? আর ধরুন একটু ভাল রাবড়িও আনানো আছে।”
“তা চলতে পারে। কিন্তু কবিতার কতদূর কী করলেন বলুন তো? কবিতার জন্যই তো আসা। খাওয়াটা তো বড় কথা নয়।”
“যে আজ্ঞে। কবিতার কথাই বলছি। আগে খাবারের কথাটা বলে দিয়ে আসি? বাড়ির মেয়েরা ময়দা মেখে বসে আছে।”
“যান যান, ওসব সেরে চট করে চলে আসুন।”
ভুবনবাবু শাঁ করে বেরিয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ বাদেই ধাঁ করে ফিরে এলেন। বললেন, “হ্যাঁ, কবিতারও বেশ এগোচ্ছে। মনে হচ্ছে কাল সকালের মধ্যে হাজারখানেক কবিতা আপনার হাতে তুলে দিতে পারব।”
লোকটা অবিশ্বাসের চোখে বলল, “বলেন কী মশাই! একদিনে এক হাজার?”
“তার বেশিও হতে পারে।”
লোকটা মৃদু মৃদু মাথা নেড়ে বলল, “আপনাকে পুরুষই বলতে হয়। রবীন্দ্রনাথও পারতেন না এরকম। তা সে যাই হোক। কবিতা ফেললেই একেবারে নগদ টাকায় কিনে নিয়ে যাব। ভাববেন না।”
ভুবনবাবু হাত কচলাতে কচলাতে বললেন, “যে আজ্ঞে।”
লোকটা আর-একটা হাই তুলে বলল, “আপনাদের এ-জায়গার বাতাসে কবিতার জীবাণু আছে মশাই। মনে হয় এখানে খুঁজলে আরও কবি বেরোবে।”
ভুবনবাবু বিবর্ণ মুখে বললেন, “আজ্ঞে না, এখানে কবি বলতে তো শুধু
আমি আর আমার ছেলেরা। আর তো কেউ…”
লোকটা ঘন-ঘন মাথা নেড়ে বলল, “উঁহু উঁহু। মানতে পারছি না মশাই। একটু আগে আমার শিয়রের জানালায় একটা লোক এসে দাঁড়াল। তার মাথাটা ন্যাড়া, বেশ জমপেশ গোঁফ আছে। বলব কী মশাই, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গোটা চারেক কবিতা আউড়ে গেল। দিব্যি কবিতা। যেমন ছন্দ, তেমনি মিল।”
ভুবনবাবু প্রায় ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে বললেন, “ওঃ, ও তো আমারই লোক কি না।”
“তার মানে?”
“আজ্ঞে, ও আমার সব কবিতা মুখস্থ করে পাঁচজনকে শুনিয়ে বেড়ায়।”
“বটে! তাই বলুন। আমি তো কবিতা শুনে ভারি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলুম। কিনব বলে তাড়াতাড়ি উঠে মানিব্যাগ খুঁজছিলাম, সেই ফাঁকে কোথায় কেটে পড়ল।”
“আজ্ঞে, ওসব নিয়ে ভাববেন না। কাল সকালে ওসব কবিতা আমি আপনার হাতে পৌঁছে দেব।”
“তা হলে তো চমৎকার। হাজারখানেক পেলে আমাদের পত্রিকার মালিকও খুশি হবেন, আর আমাকেও বেশি ছোটাছুটি করতে হবে না। বাঁচালেন মশাই।”
ভুবনবাবু চারদিকে চেয়ে বললেন, “আপনার সঙ্গীটিকে তো দেখছি না।”
“ও একটু পাগলা লোক। কোথাও গেছে-টেছে। এসে পড়বে।”
“কিন্তু ওঁর খাবারদাবার।”
“নিয়ে আসুন। এলে খাবে, নইলে আমিই ওর ভাগেরটা খেয়ে নেব।”
“যে আজ্ঞে।”
ভুবনবাবু ব্যস্ত সমস্ত হয়ে বেরোলেন। বেরিয়েই দেখলেন, ন্যাড়ামাথা লোকটা বারান্দায় এক কোণে ঘাপটি মেরে বসে আছে।
ভুবনবাবু সোজা গিয়ে লোকটাকে ঘ্যাঁচ করে ধরলেন, “আজ এক্ষুনি গিয়ে চার বস্তা কবিতা নিয়ে এসো।”
“আজ্ঞে মশাই, তার হ্যাপা আছে।”
“কত টাকা চাই?”
“দু’হাজার পেলে চেষ্টা করে দেখতে পারি।”
“দিচ্ছি।” বলে ভুবনবাবু মহাব্যস্ত, তখন অন্যদিকে ল্যাবরেটরির ঘরে তিনজন গভীর পরামর্শে মগ্ন। তিনজন হল ভুতো, রামলাল আর নন্দলাল।
ভুতো পুরো কাহিনীটা বলে একটু দম নিচ্ছিল।
রামলাল ভাবিত মুখে বললেন, “তা হলে এই হল ব্যাপার।”
নন্দলালের মুখও ব্যাজার। তিনি বললেন, “সবই তো বুঝতে পারছি। কিন্তু বাবাকে ঠেকানোই সে সমস্যা। ওঁর মাথায় একবার যেটা ঢুকবে সেটাকে তো আর বের করা যাবে না।”
রামলাল একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “দুলালবাবু এই রূপান্তর তা হলে একটা সায়েন্টিফিক অ্যাকসিডেন্ট? কিন্তু ভুতো, তোর ভূতের গল্প আমার তেমন বিশ্বাস হচ্ছে না। তোর পরির গল্পও না।”
ভুতো খুব বিনয়ের সঙ্গে বলল, “বিশ্বাস না করতে চাইলে আর কী করব বলো। তবে কর্তাবাবু যে আকাশে উঠে গেলেন, সেটা কী করে হল তা বলবে
নন্দবাবু ভূত-ভক্ত লোক। দাদার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললেন, “তুমি দু’পাতা বিজ্ঞান পড়ে ধরাকে সরা বলে ভাবছ কেন? আর বিজ্ঞান পড়ে তোমার ক’টা ডানাই বা গজাল? বাবা তো বিজ্ঞান-টিজ্ঞান বিশেষ জানেন না, কিন্তু তোমাকে টেক্কা দিয়ে রোজ নানারকম আবিষ্কার করে ফেলতেন কী করে বলো। ভুতুড়ে কাণ্ড নয়?”